ছোটনাগপুরের রানী...আমি কি তোমায় চিনি
"ঝরনা, তোমার স্ফটিক জলের
স্বচ্ছ ধারা--
তাহারি মাঝারে দেখে আপনারে
সূর্য তারা।"
অনাবশ্যক রাস্তার বর্ণনা দিয়ে পাঠকের মাথাব্যথা না বাড়িয়ে সোজা পৌছে গেলাম রাঁচি। সেখান থেকে লোহারডাগা হয়ে গুমলাগামী রাস্তা ধরে ৫০ - ৬০ কিমি এগুলেই শুরু হয় পাহাড়ি আঁকাবাঁকা জঙ্গলের রাস্তা। রাঁচি থেকে নেতারহাটের দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিমি। তাই অপটু হাতে প্রকৃতিদেবীকে নিজের ক্যামেরায় বন্দী করার ব্যার্থ চেষ্টা করতে করতে যখন নেতারহাট পৌছলাম তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় ১১ ছুঁইছুঁই।
রাত্রি জাগরন আর প্রায় ১০ ঘন্টা একটানা গাড়ি চালানোর ধকল শরীরটাকে বেশ কাহিল করার চেষ্টা করলেও সেটিকে বেশি আমল না দিয়ে হোটেলে ঢুকে বেশ সুন্দর করে স্নান করে ততোধিক সুন্দর দেশি মুরগা দিয়ে দিয়ে গরম গরম ভাত খেয়ে বেরিয়ে পরলাম নেতারহাট পরিদর্শনে। সূয্যিমামা তখন গুটি গুটি পায়ে অস্ত যাওয়ার পথে তাই দেরি না করে গাড়ি ছোটালাম Magnolia Sunset View Point এর পথে। এই ভিউ পয়েন্টটার নামকরনের পেছনে একটা দু:খজনক কাহিনী লুকিয়ে আছে। Magnolia নামে এক বৃটিশ দুহিতা একটি লোকাল রাখালের কাছে প্রত্যাখ্যাত আর অপমানিত হয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। তার স্মৃতিরখ্যার্থে এই চত্বরটার নাম হয় Magnolia View Point।
সুর্যাস্তের সময় নেতারহাট শহর থেকে ১০ কিমি দূরে সুন্দর সাজানো এই সানসেট পয়েন্টটা থেকে দেখলে মনে হয় যেনো পুরো নেতারহাট পাহাড়ের রেঞ্জটা আলোকছটায় সেজে উঠেছে আর নিচ দিয়ে কোয়েল নদী সোনাগলা রং নিয়ে বয়ে চলেছে। অসাধারণ দৃশ্যটা যেনো ' হয়েও হইলো না শেষ'। তাই নেতারহাটের দিকে ফেরার পথে গোধূলির কনে দেখা সন্ধ্যায় মনটা যেনো একবারের জন্য হলেও গেয়ে উঠলো....
সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক বেশতো
গোধূলির রঙে হবে এ ধরণী স্বপ্নের দেশতো
বেশ তো বেশ তো।
' পীরতম্ বসে পাহাড় পর্
ম্যায় কোয়েল নদীকে তীর
তুমসে কব্ মিলন হোগা
পাঁও পড়ি জাঞ্জীর।'
পরেরদিন ভোরবেলাতেই সমস্ত বন পাহাড় বিচিত্র শব্দে মুখরিত হয়ে উঠল। কতরকম পাখির ডাক, পৃথিবীতে যে এত রকম পাখী এত বিচিত্র সুরে একত্রে ডাকতে পারে এখানে না এলে জানতেই পারতাম না। যেন প্রাকৃতিক এলার্মগুলো ষড়যন্ত্র করে একসাথে বেজে চলেছে। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পাঞ্জাবিটা গায়ে চড়িয়ে বারান্দায় বেরিয়ে দেখি একটা দশ বারো বছরের আদিবাসী মেয়ে একটা ভাঙ্গা ঝুড়িতে বিস্তর সাদায় হলুদ মেশানো টোপা টোপা ফল নিয়ে বাগানে বাঁধা গরুটার সামনে ঢেলে দিলো। অবাক হয়ে পাশে দাড়ানো কেয়ারটেকারটাকে জিজ্ঞেস করাতে বললো বাবু এগুলো হলো মহুয়া ফল। এই মহুয়াই এখানকার লোকেদের জীবনসুধা। কাল সারারাত হাওয়ায় যে মিষ্টি মাতাল করা বাস পেয়েছেন তা এই মহুয়ার। এর অনেক গুণ, গরুকে খাওয়ালে দুধের পরিমান বাড়বে, মানুষকে খাওয়ালে সারাদিন ঘুমাবে, আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে শুখা মহুয়া গরম করে শেক দিলে ব্যথা পুরো গায়েব।
একটা পেয়ারা গাছের ছায়ায় বসে ছোটহাজারী সারতে সারতে এরকম অনেক আগডুম বাগডুম গল্প করে যখন রেডি হয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলাম তখন ঘড়ির কাঁটা সবে নটা পেরিয়েছে। আমাদের আজকের গন্তব্য ভারতের ২১ তম সর্বোচ্চ জলপ্রপাত লোধ ফলস।
লোধ ফলস বা বুরহাঘাট ফলসটি পালামৌ জঙ্গলের গভীরে বুরহা নদীর ওপর অবস্থিত। ভরা বর্ষায় এই জলপ্রপাতটির শব্দ প্রায় ১০ কিমি দূর থেকে শোনা যায়। এটি রাচী থেকে ২০০ কিমি, ডালটনগঞ্জ থেকে ১২০ কিমি, আর নেতারহাট থেকে ৬৫ কিমি।
পালামৌ নামটা এসেছে পালাম্যুঁ শব্দটা থেকে। এটি একটি দ্রাবিড় শব্দ। পা্ল মানে দাঁত, আম্ম মানে জল, আর উঁ মানে জঙ্গল। অর্থাৎ দাঁত বের করা নদী আর জঙ্গল। চারপাশে অর্জুন, শাল ( স্থানীয় নাম শাকুয়া), শিশু, পলাশ, কৃষ্ণচুড়া গাছের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ চলে গেছে মহুয়াডোরের দিকে। মহুয়াডোরে জেঠ শিকার উপলখ্যে মে মাসের শেষ থেকে জুন মাসের মাঝামাঝি সময় অব্দি বেশ জমজমাট মেলা বসে। মহুয়াডোরের একটা ছোটো ধাবাতে রুটি আর দেশি চিকেন দিয়ে ভরপেট খেয়ে যখন ফলসের সামনে পৌছলাম তখন সুয্যিমামা ঠিক মাথার উপর। পাহাড়ের ছোট ছোট খাঁজ থেকে অসীম বেগে জলধারা বেরিয়ে প্রায় ৫০০ ফিট নিচে নেমে যে জলপ্রপাতটা তৈরি হয়েছে তাকে ভাষায় বর্ণনা করার দু:সাহস আমার নেই, তাই সেই চেষ্টাও করলাম না। বরং পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পা দিয়ে উঠে পরলাম একেবারে ফলসের মাথায়। তারপর শুধু ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক। কোথা থেকে যে তিন ঘন্টা কেটে গেলো মালুমই পেলাম না। এবার ঘরে ফেরার পালা। পথের ধারে একটা ছোটো চায়ের দোকানে একটু গলা ভিজিয়ে ফিরে চললাম নেতারহাটের দিকে। সেদিন ছিলো পুর্ণিমা। হঠাৎ এক পথের বাঁক ঘুরতেই চোখে পরলো হলুদ থালার মতন চাঁদটা পাহাড়ের মাথা থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্তে আকাশের গা বেয়ে উঠতে থাকলো আর ঘন নীল আকাশ থেকে নীল আর হলুদ রং ঝরে সমস্ত জঙ্গলটাকে যেন সাদা রং এ রাঙিয়ে দিলো। গাড়ির র্স্টাটটা বন্ধ করে মেয়ের হাতটা ধরে বেরিয়ে পরলাম জঙ্গলের ছায়ার আলিঙ্গনে। আর ঝিঁঝিঁ পোকার আবহসঙ্গীতের সাথে পাল্লা দিয়ে আমার মেয়ে গেয়ে চলল....
একটা পেয়ারা গাছের ছায়ায় বসে ছোটহাজারী সারতে সারতে এরকম অনেক আগডুম বাগডুম গল্প করে যখন রেডি হয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলাম তখন ঘড়ির কাঁটা সবে নটা পেরিয়েছে। আমাদের আজকের গন্তব্য ভারতের ২১ তম সর্বোচ্চ জলপ্রপাত লোধ ফলস।
লোধ ফলস বা বুরহাঘাট ফলসটি পালামৌ জঙ্গলের গভীরে বুরহা নদীর ওপর অবস্থিত। ভরা বর্ষায় এই জলপ্রপাতটির শব্দ প্রায় ১০ কিমি দূর থেকে শোনা যায়। এটি রাচী থেকে ২০০ কিমি, ডালটনগঞ্জ থেকে ১২০ কিমি, আর নেতারহাট থেকে ৬৫ কিমি।
পালামৌ নামটা এসেছে পালাম্যুঁ শব্দটা থেকে। এটি একটি দ্রাবিড় শব্দ। পা্ল মানে দাঁত, আম্ম মানে জল, আর উঁ মানে জঙ্গল। অর্থাৎ দাঁত বের করা নদী আর জঙ্গল। চারপাশে অর্জুন, শাল ( স্থানীয় নাম শাকুয়া), শিশু, পলাশ, কৃষ্ণচুড়া গাছের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ চলে গেছে মহুয়াডোরের দিকে। মহুয়াডোরে জেঠ শিকার উপলখ্যে মে মাসের শেষ থেকে জুন মাসের মাঝামাঝি সময় অব্দি বেশ জমজমাট মেলা বসে। মহুয়াডোরের একটা ছোটো ধাবাতে রুটি আর দেশি চিকেন দিয়ে ভরপেট খেয়ে যখন ফলসের সামনে পৌছলাম তখন সুয্যিমামা ঠিক মাথার উপর। পাহাড়ের ছোট ছোট খাঁজ থেকে অসীম বেগে জলধারা বেরিয়ে প্রায় ৫০০ ফিট নিচে নেমে যে জলপ্রপাতটা তৈরি হয়েছে তাকে ভাষায় বর্ণনা করার দু:সাহস আমার নেই, তাই সেই চেষ্টাও করলাম না। বরং পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পা দিয়ে উঠে পরলাম একেবারে ফলসের মাথায়। তারপর শুধু ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক। কোথা থেকে যে তিন ঘন্টা কেটে গেলো মালুমই পেলাম না। এবার ঘরে ফেরার পালা। পথের ধারে একটা ছোটো চায়ের দোকানে একটু গলা ভিজিয়ে ফিরে চললাম নেতারহাটের দিকে। সেদিন ছিলো পুর্ণিমা। হঠাৎ এক পথের বাঁক ঘুরতেই চোখে পরলো হলুদ থালার মতন চাঁদটা পাহাড়ের মাথা থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্তে আকাশের গা বেয়ে উঠতে থাকলো আর ঘন নীল আকাশ থেকে নীল আর হলুদ রং ঝরে সমস্ত জঙ্গলটাকে যেন সাদা রং এ রাঙিয়ে দিলো। গাড়ির র্স্টাটটা বন্ধ করে মেয়ের হাতটা ধরে বেরিয়ে পরলাম জঙ্গলের ছায়ার আলিঙ্গনে। আর ঝিঁঝিঁ পোকার আবহসঙ্গীতের সাথে পাল্লা দিয়ে আমার মেয়ে গেয়ে চলল....
" I had an inheritance from my father,
It was the moon and the sun
I can move throughout the world now
the spending of it is never done "
কিভাবে যাবেন :-
By Bus : ধর্মতলা থেকে প্রচুর বাস ছাড়ে সোজা নেতারহাটের জন্য। সময় লাগে ১৪ ঘন্টা।
By Train : কলকাতা থেকে রাঁচিগামী যেকোনো ট্রেনে উঠে পড়ুন নেতারহাটের উদ্দেশ্যে। সব থেকে কাছের স্টেশন কুমেন্দী। ওখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে বা লোকাল বাসে চেপে সোজা নেতারহাট। ট্রেনে লাগে ৮ ঘন্টা, রাঁচি থেকে নেতারহাট লাগে ৩.৩০ ঘন্টা।
কোথায় থাকবেন :-
ঝাড়খন্ড টুরিজমের প্রভাত বিহার ছাড়াও বেশ কিছু হোমস্টে আর কিছু বাজেট হোটেল পাবেন নেতারহাটে।
ঝাড়খন্ড টুরিজমের প্রভাত বিহার ছাড়াও বেশ কিছু হোমস্টে আর কিছু বাজেট হোটেল পাবেন নেতারহাটে।
কখন যাবেন :-
অক্টোবর থেকে মার্চ নেতারহাট ঘোরার সব থেকে আদর্শ সময়।
অক্টোবর থেকে মার্চ নেতারহাট ঘোরার সব থেকে আদর্শ সময়।
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরন -
১. এই সার্কিটে পুর্বে যদি গাড়ি চালানোর অভিজ্জতা না থাকে তবে রাতে গাড়ি না চালানোই ভালো।নিরাপত্তা জনিত সমস্যা হতে পারে।
২. কলকাতা থেকে রাঁচি যাওয়ার অনেকগুলি রাস্তা থাকলেও আমি সাধারণত কলকাতা - আসানসোল - রঘুনাথপুর - পুরুলিয়া বাইপাস - ঝালদা - মুড়ি - রাঁচি রাস্তাটা বেশি পছন্দ করি। রাস্তাটা পুরোটাই সুন্দর এবং সব থেকে বড় কথা রাস্তাটায় লরির উৎপাত খুবই কম।
১. এই সার্কিটে পুর্বে যদি গাড়ি চালানোর অভিজ্জতা না থাকে তবে রাতে গাড়ি না চালানোই ভালো।নিরাপত্তা জনিত সমস্যা হতে পারে।
২. কলকাতা থেকে রাঁচি যাওয়ার অনেকগুলি রাস্তা থাকলেও আমি সাধারণত কলকাতা - আসানসোল - রঘুনাথপুর - পুরুলিয়া বাইপাস - ঝালদা - মুড়ি - রাঁচি রাস্তাটা বেশি পছন্দ করি। রাস্তাটা পুরোটাই সুন্দর এবং সব থেকে বড় কথা রাস্তাটায় লরির উৎপাত খুবই কম।
Comments
Post a Comment