ঘাটশিলার ডায়েরী ( The story of Ghatshila )









নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশের একটা কবিতায় ঘাটশিলা এসেছিল এইভাবে
 "ঘাটশিলা—ঘটশিলা— কলকাতা ছেড়ে বল ঘাটশিলা কে যায় মিছাই চিরদিন কলকাতা থাকি আমি, ঘাটশিলা ছাই। ... একদিন তারপর—বহুদিন পরে অনেক অসাধ অনিচ্ছায় ঘাটশিলা চলিলাম ঘাটশিলা দেখিলাম হায় ..."”
শীতের কুয়াশামাখা সাপ্তাহিক ছুটি গুলি এলেই পায়ের তলার সরষে গুলো কিলবিল করে ওঠে।  মন বলে পালাই পালাই। টুক করে তাই গাড়িটা নিয়ে ঘুরে এলাম ঘাটশিলা থেকে। ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলার ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ ঘাটশিলা বাঙালি পর্যটকদের কাছে বরাবরই আকর্ষণীয়। চারিদিকে অনুচ্চ পাহাড়শ্রেণি, মাঝে আপনবেগে পাগলপারা সুবর্ণরেখা, অন্য দিকে শাল-মহুয়ার জঙ্গল ঘাটশিলাকে ব্যতিক্রমী রূপ দিয়েছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতি। অপূর্ব মায়াময় এই ছোট্ট শহরটি। আদিবাসী রমনীর দল বেঁধে হাঁটে যাওয়া, হাটে বসে বিক্রি করা পিঁপড়ের ডিম, হাঁড়িয়া আর নিমের দাঁতন । যুগ যুগ ধরে মানুষের সেবা করে আসা গ্রামীন ডাক্তার, যার কাছে জড়ি-বুটির সংখ্যা ২৫০০ রকমেরও  বেশি । পূরাতন অনূভূতির শহর । আনাচে কানাচে যার আদিবাসী জীবন ও সারল্য ।

কিভাবে যাবেন :-


কলকাতা থেকে ঘাটশিলা যাওয়ার মেন রাস্তা কলকাতা - খরগপুর - বাহাড়গোড়া - ধললভুমগড় - ঘাটশিলা।
যদিও বাহাড়গোড়া থেকে ঘাটশিলার ৫০ কিমি রাস্তার কাজ চলছে ফলে রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। তার বদলে খরগপুর হয়ে লোধাসুলি থেকে ডানদিকে ঝাড়্গ্রামের দিকে বেঁকে চিল্কিগড় - জামবনি - পাড়িহাটি - চাকুলিয়া - ধললভুমগড় হয়ে ঘাটশিলা ঢোকা ভালো।
ট্রেনে গেলে - কলকাতা থেকে ঘাটশিলায় সুপারফাস্ট ট্রেনের স্টপ নেই । কলকাতা থেকে দূরত্ব ২১৫ কিমি, ৩.৫ ঘন্টার পথ । হাওড়া থেকে ২৮৭১ ইস্পাত এক্সপ্রেস ৬-৫৫, স্টিল এক্সপ্রেস ১৭-৩০, শালিমার এল টি টি এক্সপ্রেস ১৫-০০ টায় শালিমার ছেড়ে ১-৫৩, ২০-৩৬, ১৯-১৮ ছেড়ে সরাসরি ঘাটশিলা যাওয়া যায় ।

কি দেখবেন :-

প্রথম দিন পাবেন :-

চিল্কিগড়, কনকদূর্গা মন্দির ও ডুলুং নদী
চিল্কিগড় নামটা বেশ রোমাঞ্চকর,চিল্কিগড়ে শতাব্দী প্রাচীন কনকদূর্গার মন্দির অবশ্য দ্রষ্টব্য। মাঝে ডুলুং নদী, নদীর ঠাণ্ডা জলে পা ভিজিয়ে শরীর ঠাণ্ডা করে আমরা বসে পড়লাম নদীর পাশের ঘাষজমিতে। দেখে নিতে পারেন শতাব্দী প্রাচীন চিল্কিগড় রাজবাড়ী।



 চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেকার বইয়ে পড়া জঙ্গল ঘেরা ঘাটশিলার সঙ্গে এখনকার ঘাটশিলাকে কিন্তু মেলাতে যাবেন না। বন কেটে বসতবাড়ি,ওভার ব্রিজ,  ডিজেলের ধোঁয়া ছড়ানো অটো,ট্রেকার , বিশ্বের দ্বিতীয় গভীরতম তামার খনি 'হিন্দুস্থান কপার' ঘাটশিলার বন্য সৌন্দর্যে অনেকটাই চোনা ফেলে দিয়েছে।  তবুও ছোট্ট ঘাটশিলার অন্যতম আকর্ষণ বিভূতিভূষণের স্মৃতিবিজড়িত  'গৌরীকুঞ্জ'। গৌরীদেবী ছিলেন তাঁর প্রথম স্ত্রী যার নামেই বিভূতিভূষণ তাঁর বাসার নামকরণ করেছিলেন 'গৌরীকুঞ্জ। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল মাত্র এক বছরের। গৌরীর মৃত্যুর কুড়ি বছর পরে তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন। পুত্র তারাদাস তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান।  বাড়িটারও একটা কাহিনি আছে, বিভূতিভূষণ নিজে বাড়িটা বানান নি। ' কোন এক বন্ধু তাঁর কাছে কয়েকশ' টাকা ধার নিয়ে আর শোধ করতে পারেন নি। সে ভদ্রলোক শিক্ষাব্রতী ছিলেন। গালুডি ঘাটশিলা অঞ্চলের আরণ্যক শ্রীর প্রতি বিভূতির আকর্ষণ লক্ষ্য করে বন্ধুটি জোর করেই নিজের ঘাটশিলার বাড়িটি বিভূতিকে গছিয়ে নিজেকে আর্থিক ঋণ থেকে মুক্ত করেছিলেন।  গৌরীকুঞ্জেই বিভূতিভূষণের মৃত্যু হয় ১লা নভেম্বর ১৯৫০-এ।

বুড়াডি ড্যাম


 আমাদের পরের দ্রষ্টব্য বুরুডি লেক। পাহাড়ের মাথায় আস্ত একটা জলাশয়। বুরুডি ড্যামের উপর থেকে আশপাশটা দারুণ দেখায়। গালুডির চারপাশে প্রচুর ছোট ছোট টিলা রয়েছে। ট্রেকিংয়ের অভ্যেস থাকলে টুক করে উঠে যেতে পারেন টিলাগুলোর মাথায়। আর হ্যাঁ, আপনি যদি ভোজন রসিক হন তাহলে অতি অবশ্যই ড্যামের পাশে ছোট ছোট ঝোপড়া গুলিতে দেশী মুরগার ঝোল আর ভাত ট্রাই করে দেখবেন।দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি হতাশ হবেন না।
 বুরুডি লেক থেকে আরও কিমি তিনেক জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেলে দেখা পাবেন ধারাগিরি ফলস্‌। পাহাড়-জঙ্গলের মাঝে সুন্দরী ঝরনা। জঙ্গলের মধ্যে গাড়ি রেখে মিনিট পনেরো হাটতে হয়।



১১ কিমি দূরে সুবর্ণরেখার ওপরে গালুডি ড্যামটাও দেখার মতো। গালুডি দেখে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম জাদুগোড়ার দিকে।



জাদুগোড়ায় পাহাড়ের ঢালে জাগ্রত রনকিনি দেবীর মন্দির । রাজা ধবলদেব এখানে মা দুর্গার মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের বিখ্যাত উৎসব বিন্দ মেলা এখানেই হয়।



আমাদের আজকের শেষ গন্তব্য সুবর্নরেখা নদী।
আজও নাকি সোনা মেলে বালুতটে, দেখতেও মেলে নদীচরে সকাল সাঁঝে। তাই নদীর নাম সুবর্ণরেখা। যদিও চারিদিকে অযত্নের ছাপ। তবুও নদীর পাশে বসে সুর্যাস্ত উপভোগ করার এক আলাদা মাধুর্য আছে।

দ্বিতীয় দিন :-
সকাল সকাল হোটেলে প্রাতরাশ সেরে বেড়িয়ে পড়লাম জামশেদপুরের উদ্দেশ্যে।
আজকের দ্রষ্টব্য  - ডিমনা লেক, চাণ্ডিল ড্যাম আর জুবিলি পার্ক।




ডিমনা লেক ও চান্ডিল ড্যাম: দলমা পাহাড়ের পাদদেশে ডিমনা লেক ও চান্ডিল ড্যাম। ৭০ ফুট গভীর, ৭ কিমি লম্বা ও ২ কিমি চওড়া এই লেক থেকেই শহরে জলসরবরাহ করা হয়। আছে বোটিংয়ের ব্যবস্থাও।


জুবিলি পার্ক: ১৯৫৮ সালে ২২৫ একর জমির উপর জামশেদজি টাটা গড়ে তোলেন এই সুন্দর পার্কটি। নানা রকমের ফুল ও অন্যান্য গাছ, নানা প্রজাতির গোলাপ শোভা বর্ধন করেছে পার্কটির। আছে মোঘল গার্ডেন, চিল্ড্রেন গার্ডেন, ফোয়ারা। সন্ধ্যায় লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের আসর বসে।
চান্ডিল ড্যাম দেখে এবার ফেরার পালা। যে পথে গেছি সেই পথে ফিরতে বেশ বোর লাগে। তাই নতুন পথের খোজ। চান্ডিল থেকে বলরামপুর ৩০ কিমি। রাস্তাটায় একটু খানাখন্দ পাবেন। সেখান থেকে ডানদিকে একটা রাস্তা চলে গেছে বান্দোয়ানের দিকে, সেই রাস্তা ধরে চলে যান মানবাজার - তালডাংরা - বিষ্ণুপুর - কোতলপুর - আরামবাগ - কলকাতা। পুরো রাস্তাটাই ঝকঝকে সুন্দর।

থাকবেন কোথায় :-
ঘাটশিলায় ঝাড়খণ্ড সরকারের ট্যুরিস্ট লজ ‘বিভূতি বিহার’ চেহারায় বিশাল। জাতীয় সড়কের উপরে ওই অতিথিশালা নিসর্গ উপভোগ করার পক্ষে আদর্শ। কিন্তু ভিতরে ঢুকলেই হতশ্রী অবস্থা চোখে পড়বে। পলেস্তরা খসে পড়ছে, চতুর্দিকে অপরিচ্ছন্ন ছাপ।যদিও নতুন করে আবার সাজানো হচ্ছে পর্যটকদের জন্য।
এছাড়াও বেশ কিছু হোটেল ও রিসর্ট গড়ে উঠেছে ঘাটশিলাকে ঘিরে। সুবর্ণরেখা নদীর পাশে সুন্দর পরিবেশে রয়েছে রিসর্ট অন্বেষা।(৯৮৩০৪৫৬১১২/৯৯০৩৩৪৯৯৯৯)। ভাড়া ৬৫০ টাকা-৭৫০ টাকা।
হোটেল আকাশদীপ (৯৫৭০০৫৮৯৬৯) ডাবলবেড ৭৫০ টাকা-৯০০ টাকা। এসি ১২৫০ টাকা। ছয়শয্যা ১৪০০-১৬০০ টাকা। হোটেল রিভারভিউ (৯৪৩১৫৪৩৯৬৮) ডাবলবেড ৬০০- ৭০০ টাকা।



Comments

Popular posts from this blog

Keonjhar – A hidden Gem of Orissa

মান্ডুর প্রেম কথা