The Unfold story of Garhpanchokot
পৰ্ব্বতকুলের পাখা ; কিন্তু হীনগতি
সে জন্য নহ হে তুমি, জানি আমি মনে,
পঞ্চকোট !
আপনারা হয়তো ভাবছেন একি ধান ভানতে শিবের গীত কেন। লিখতে তো বসেছি ভ্রমন কাহিনী হঠাৎ করে মাইকেল মধুকবি কে ডাকাডাকি কেন। আসলে বাংলার অন্যতম বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন কবির সাথে বাংলার অন্যতম প্রভাবশালী রাজবংশের যোগসুত্রটা দেখতে পেয়ে আমিও খুব অবাক হয়ে গেছিলাম। আজকের মানসসভ্রমনে সেই ইতিহাসেরই একটু ঘ্রান নেওয়ার চেষ্টা।প্রচুর স্বপ্ন উচ্চাশা নিয়ে বিদেশ যাত্রা করে কবি মধুসূদন কলকাতা ফিরলেন প্রবল দারিদ্র-হতাশা এবং একটি ব্যারিস্টারী ডিগ্রী নিয়ে। ব্যবহারিক বু্দ্ধির অভাবে কলকাতা হাইকোর্টেও পসার জমাতে ব্যার্থ হলেন তিনি। তাই জীবন-সায়াহ্নে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে পুরুলিয়া শহরে আসেন একটি মোকদ্দমায় বাদীপক্ষের ব্যরিস্টার হিসাবে।
ব্যারিস্টার কবি মধুসূদন পুরুলিয়া আগমনে খ্রিস্টধর্মাবলম্বী জনগণের মধ্যে বিশেষ সাড়া পরে যায় এবং তারা তাঁকে স্থানীয় মিশন হাউসে উষ্ণ সংবর্ধনা জানান। মুগ্ধচিত্ত কবি পুরুলিয়া শহরেই রচনা করেন একটি সনেট, যার প্রথম চার পঙক্তি নিম্নরূপ:
পাষাণময় যে-দেশ, সে-দেশে পড়িলে /বীজকুল, শস্য তথা কখন কি ফলে?/কিন্তু কত মনানন্দ তুমি মোরে দিলে,/হে পুরুল্যে!...
সেই বার, পুরুলিয়ার খ্রিস্টধর্মাবলম্বী মানুষদের অনুরোধে, কবি পুরুলিয়া শহরে রাঁচি রোডের ধারে অবস্থিত গসনার ইভাঞ্জেলিকাল লুথেরান চার্চ-এ বালক কাঙালিচরণ সিংহকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন। দীক্ষান্তে সেই বালকের নাম হয় খ্রিস্টদাস সিংহ।
তার পরের মাসেই কবি দ্বিতীয় বার পঞ্চকোটে আসেন পঞ্চকোট রাজ নীলমণি সিংদেও-এর আমন্ত্রণে আইনি পরামর্শদাতা ও দেওয়ান হিসাবে।
সেই সময়ই পঞ্চকোটের রাজত্ব প্রায় অবলুপ্তের পথে। রাজপ্রাসাদ, গড়, পরিখা, ধ্বংসস্তুপে পরিনত হচ্ছে। মধুসূদন চেষ্টা করেছিলেন এই গড় ও স্থাপত্য যাতে পুনরুদ্ধার করা যায়। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা আর ভগ্নসাস্থ্য তার সঙ্কল্পে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ফলে মাত্র আট মাস কাজ করেই তিনি কলকাতা ফিরে যান। তার কয়েক মাসের মধ্যে ১৮৭৩ সালের ২৩ জুন তিনি মারা যান। এই গড়পঞ্চকোটই কবির শেষ কার্যক্ষেত্র। পঞ্চকোট থেকে বিদায় নেওয়ার পর তিনি বেশ কয়েকটি কবিতা রচনা করেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম পঞ্চকোট গিরি, পঞ্চকোটস্য রাজশ্রী এবং পঞ্চকোট গিরি বিদায় সঙ্গীত।
পঞ্চকোট রাজবংশের ইতিহাসটা কিন্তু বেশ জমজমাট।পঞ্চকোট রাজপরিবারের যাঁরা রাজকুমার তাঁরা সকলেই লালসিংহদেব নামে উল্লেখিত। যুবরাজ, যিনি পরে রাজ সিংহাসনের পদপ্রার্থী তিনি ছাড়া বাকি কুমাররা সকলেই লালসিংহ।
কথিত আছে রাজা দামোদর সিংহের(২ শকাব্দ--৬২ শকাব্দ) পিতা জগৎ সিংহের হাত ধরেই বঙ্গদেশে এই বংশের বিস্তার হয়।তিনি একবার সপরিবারে পুরিতে জগন্নাথ দর্শনে বার হন।পথে ঝালদার নিকট তাঁর অন্তঃসত্ত্বা মহীষী অসুস্থ হয়ে পড়েন, ফলে রাজা তাঁকে রেখে একাই তীর্থযাত্রা করতে চলে যান। ফিরে এসে তিনি রাজমহীষীর মৃত্যু সংবাদ পান এবং দেখেন পুত্র স্থানীয় আদিবাসীদের দ্বারা পালিত হচ্ছে। রাজা জগৎ সিংহ তখন কুমারকে ঐ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ রাজা ঘোষনা করে নিজ রাজত্বে (রাজস্থানের ধার রাজ্য) গমন করেন, এবং কুমারের বয়ঃপ্রাপ্তির পর ফিরে এসে স্থানীয় অধিবাসীদের একত্রিত করে পুত্র দামোদর সিংহের রাজ্যভিষেক করেন। কিন্তু ততদিনে সেই বয়স্ক স্থানীয় আদিবাসীরা সকলেই মৃত। সেই মানুষগুলির উপকার এবং সততার পুরস্কার স্বরূপ রাজা ওই সাতজন স্থানীয় অধিবাসীকে ‘রাণা’ নামে ভূষিত করেন। ভারতের ইতিহাসে পঞ্চকোট রাজপরিবারই প্রথম এইভাবে মরনোত্তর পুরস্কার প্রচলিত করেন। এখনো পর্য্যন্ত রাজপরিবারের কোন অনুষ্ঠানে ওই সাতজন রাণার নামে একটি নতুন মাটির হাঁড়িতে কলাই এর ডাল ও চালের খিচুড়ি রান্না করে স্থানীয় কোন পুকুরের পাড়ে নিবেদন করা হয়। ওই সাতজন স্থানীয় আদিবাসীদের প্রতি এভাবেই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয়।
পঞ্চকোট রাজপরিবারের রাজধানী কিন্তু বারে বারেই তার স্থান পরিবর্তন করেছে। মধ্যপ্রদেশের উজ্জ্বয়িনীর ধারনগর থেকে যাত্রা শুরু করে ঝালদা, পাড়া হয়ে গড়পঞ্চকোট তারপর সেখান থেকে মহারাজনগর, রামবনি, কেশরগড় হয়ে কাশীপুরে তার যাত্রা শেষ হয়।
ইতিহাস বলছে, ১৮৩২ সালে পঞ্চকোট রাজ জগজীবন সিংহ দেও হুড়ার কেশরগড় থেকে রাজধানী দ্বারকেশ্বর নদের গাঁ ঘেষা কাশীপুরে তুলে নিয়ে আসেন । কাশীপুরে এই বংশের সাতজন রাজা রাজত্ব করলেও রাজা নীলমণি ও জ্যোতিপ্রসাদের নামই ইতিহাসের পাতায় বারবার উঠে আসে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় নীলমণি সিংহ দেও-র নেতৃত্বেই পুরুলিয়া ট্রেজারি লুঠ হয়েছিল। পুরুলিয়া জেল ভাঙা আন্দোলনেরও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। জেল ভেঙে ৬৩ জন কয়েদিকে মুক্ত করা হয়।
তখন তিনমাস পুরুলিয়া ব্রিটিশ-প্রশাসন মুক্ত ছিল। পরে পুলিশ নিয়ে এসে ক্যাপ্টেন ওকস নীলমণিকে গ্রেফতার করেন। কাশিমবাজারের রানি স্বর্ণময়ী পঞ্চকোট রাজ্যের ৪৪টি মৌজার বিনিময়ে নীলমণিকে জামিনে মুক্ত করেন । কারামুক্ত হয়েই তিনি পঞ্চকোটে সাংস্কৃতিক নবজাগরণ আনেন। বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত সঙ্গীত অধ্যাপক জগচ্চন্দ্র গোস্বামী, মৃদঙ্গবাদক হারাধন গোস্বামী, বংশীবাদক পূরণ সিংহ চৌতাল বা নবদ্বীপের ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন, নৈয়ায়িক পার্বতীচরণ বাচস্পতি, কেদার ন্যায়রত্ন প্রমুখের মতো পণ্ডিতদের নিয়ে তিনি তাঁর নবরত্ন সভা চালু করেন।
রাজা নীলমণির সেই ধারা পেয়েছিলেন রাজা জ্যোতিপ্রসাদ। তাঁর রাজ্যের অন্তর্গত ধানবাদ-আসানসোল এলাকায় পরবর্তীকালে মাটির নীচ থেকে কয়লা বের হওয়ায় তার ‘রয়্যালটি’ পান জ্যোতিপ্রসাদ। আর তা থেকেই তিনি তার রাজ্যকে নিজের মতো করে সাজিয়েছিলেন। কাশীপুরে বর্তমান যে সুদৃশ রাজবাড়ি রয়েছে, তা জ্যোতিপ্রসাদেরই তৈরি। ১৯১৬ সালে এই রাজবাড়ি তিনি তৈরি করেন চিন থেকে রাজমিস্ত্রি এনে। টানা ১২ বছর ধরে চলেছিল নির্মাণ কাজ। বেলজিয়াম থেকে বিশাল ঝাড়লন্ঠন নিয়ে এসে লাগিয়েছিলেন প্রাসাদের দরবার হলে।
তবে রাজবাড়িতে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ওই বাড়িতেই রাজ পরিবারের বর্তমান বংশধররা থাকেন। শুধু পুজোর সময় রাজবাড়ির একাংশ সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
গড়পঞ্চকোটের স্থাপত্য
গড় পঞ্চকোটের অধিকাংশ স্থাপত্য বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত বা অবলুপ্তির পথে। এই স্থানে বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে, যেগুলি উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
তোরণ
১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে জে ডি বেগলার গড় পঞ্চকোট ভ্রমণ করে আঁখ দুয়ার, বাজার মহল দুয়ার, খড়িবাড়ি দুয়ার এবং দুয়ার বাঁধ নামক চারটি তোরণের বর্ণনা করেন। তিনি দুয়ার বাঁধ ও খড়িবাড়ি দুয়ারের গায়ে উৎকীর্ণ লিপিতে মল্লরাজ বীর হাম্বিরের নামের উপস্থিতি লক্ষ্য করেন, যা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে পঞ্চকোট রাজ্য মল্লভূমের অধীনস্থ হয়েছিল।
পঞ্চরত্ন মন্দির
গড় পঞ্চকোটের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য মন্দির হল একটি পঞ্চরত্ন টেরাকোটা নির্মিত দক্ষিণ ও পূর্বদুয়ারী রাস মন্দির। মন্দিরের গায়ে ফুল ও আলপনার নকশা ছাড়াও খোল, করতাল বাদনরত ও নৃত্যরত মানব-মানবীর মূর্তি পরিলক্ষিত হয়। ষাট ফুট উচ্চ কেন্দ্রীয় চূড়া বিশিষ্ট ভগ্নপ্রায় এই মন্দিরে কোন বিগ্রহ নেই। উত্তরপশ্চিম দিকে অপর একটি পঞ্চরত্ন টেরাকোটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, বর্তমানে যার চারটি চূড়া নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ও মধ্যের ৪০ ফুট উচ্চ চূড়াটি অবশিষ্ট রয়েছে।
কঙ্কালী মাতার মন্দির
গড়ের পশ্চিমদিকে প্রস্তর নির্মিত কঙ্কালী মাতার ভগ্নপ্রায় মন্দিরের অস্তিত্ব বর্তমান। মন্দিরের সামনের অংশ অক্ষত হলেও পেছনের অংশ সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত। কঙ্কালী মাতা পঞ্চকোট রাজ্যের কুলদেবী হলেও বর্তমানে এই মন্দিরে কোন বিগ্রহ নেই। মন্দিরের প্রবেশপথের ওপরে কোন লিপি বা মূর্তি খোদিত ছিল, যা বর্তমানে বিনষ্ট হয়েছে।
পঞ্চকোট রাজবংশের নির্মিত বহু স্থাপত্যের নিদর্শন পুরুলিয়া বা তার পার্শবর্তী অঞ্চলে পাওয়া যায়। তার মধ্যে অন্যতম মাতা কল্যানেশ্বরীর মন্দির।এই মন্দির নির্মান নিয়ে অনেক অলৌকিক গল্প প্রচলিত আছে।অনেকে বলেন পঞ্চকোট রাজবংশের রাজা কল্যাণশেখরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বল্লাল সেনের পালিতা কন্যা সাধনার। বাপের বাড়িতে সাধনা প্রতিদিন কুলদেবী শ্যামারূপার সেবা না করে জলস্পর্শ করতেন না। তাই তিনি বিয়ের পরে বাবার কাছে শ্যামারূপা দেবীকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করেন। আদরের দুলালী সাধনার প্রার্থনা শুনে বল্লাল সেন বিচলিত হলেও নামঞ্জুর করতে পারেন না। তিনি মায়ের মুর্তি আর সঙ্গে একটি কালো রঙের ঘোড়া দিয়ে মেয়ে জামাইকে বিদায় দেন। এবং বারংবার সাবধান করে দেন মুর্তি যেনো কোন কারনেই মাটিতে রাখা না হয়।পথে ক্লান্ত নবদম্পতি একটু বিশ্রামের আশায় দেবীকে একটি গুহার মধ্যে থেকে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। বিশ্রামের পর যাত্রা শুরু করতে গিয়ে হল বিপদ। অনেক চেষ্টা করেও দেবীমূর্তি নড়ানো গেল না। সাধনা নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঠিক করলেন তিনি তার নিজের প্রাণ বিসর্জন দেবেন। সহধর্মিণীর কথা শুনে কল্যাণশেখরও আত্মাহুতি দেবেন বলে ঠিক করলেন।
কথিত আছে সেই সময়েই নাকি দেবী তাঁদের দেখা দেন। কেউ আবার বলেন তারা যখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তখন স্বপ্নে দেবী তাঁদের দেখা দেন। দেবী নির্দেশ দেন, ‘‘আমি এখানেই (মোচলপুর) থাকব। নাম হবে কল্যাণেশ্বরী। আর শ্বশুরবাড়িতে ফিরে গিয়ে তুই আমার চর্তুভুজা মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিস। ওখানে আমার নাম হবে রাজরাজেশ্বরী।’’
এইভাবে ইতিহাস আর প্রকৃতি আর লোকগল্প যেন একে অপরের হাত ধরাধরি করে রয়েছে এই বংশের অলিতে গলিতে। কিন্তু সরকারের উদাসীনতায় হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস — হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ। দেউলগুলির এতটাই জীর্ণ দশা যে, যেকোনও সময় ভেঙে যাবে। ইতিহাস বলে পঞ্চকোট পাহাড় জুড়ে প্রচুর গাছ লাগিয়েছিলেন রাজারা। শাল, পিয়াল, মহুয়া’র পাশাপাশি গুলঞ্চ, বহড়া, নিম, আমলকি, হরিতকী প্রভৃতি গাছ রয়েছে পাহাড় জুড়ে। যদিও বন দপ্তরের অদূরদর্শীতায় রাতের অন্ধকারে প্রায়শই গাছ কাটা চলছে। পুরোনো ইতিহাসের পাতা হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের লোভ, উদাসীনতা আর অজ্ঞতার অন্ধকারে।মাইকেলের ভাষাতেই তাই উপসংহার টেনে বলি
কীভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে ট্রেনে গিয়ে নামতে পারেন বরাকর, অথবা কুমারডুবি অথবা আদ্রা স্টেশনে। বরাকর থেকে গড় পঞ্চকোটের দূরত্ব ১৯ কিমি। কুমারডুবি থেকে দূরত্ব ১৪ কিমি। আদ্রা থেকে দূরত্ব ২৫ কিমি। এই তিন স্টেশন থেকেই অটো ভাড়া করে পৌঁছে যান গড় পঞ্চকোটে। কুমারডুবি সবচাইতে কাছে কিন্তু যোগাযোগ ভালো বরাকর বা আদ্রা কিংবা আসানসোল (৪৯ কিমি) থেকে।
আগে থেকে গাড়ি বুক করে রাখলে তাতেও সওয়ারি হতে পারেন।
রেলপথ ছাড়াও সড়ক পথে NH-2 ধরে, আসানসোল থেকে দিশেরগড় হয়ে চিরকুন্ডা রোড ধরে পৌঁছে যেতে পারেন গড় পঞ্চকোটে।
কোথায় থাকবেন
গড় পঞ্চকোটে রাত্রিবাসের সেরা ঠিকানা পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের বাংলো, ভাড়া- ১,৫০০-৪,৫০০ টাকার মধ্যে। যোগাযোগ- ০৩৩-২৩৩৫০০০৬৪।
পঞ্চকোট রাজবংশের ইতিহাসটা কিন্তু বেশ জমজমাট।পঞ্চকোট রাজপরিবারের যাঁরা রাজকুমার তাঁরা সকলেই লালসিংহদেব নামে উল্লেখিত। যুবরাজ, যিনি পরে রাজ সিংহাসনের পদপ্রার্থী তিনি ছাড়া বাকি কুমাররা সকলেই লালসিংহ।
কথিত আছে রাজা দামোদর সিংহের(২ শকাব্দ--৬২ শকাব্দ) পিতা জগৎ সিংহের হাত ধরেই বঙ্গদেশে এই বংশের বিস্তার হয়।তিনি একবার সপরিবারে পুরিতে জগন্নাথ দর্শনে বার হন।পথে ঝালদার নিকট তাঁর অন্তঃসত্ত্বা মহীষী অসুস্থ হয়ে পড়েন, ফলে রাজা তাঁকে রেখে একাই তীর্থযাত্রা করতে চলে যান। ফিরে এসে তিনি রাজমহীষীর মৃত্যু সংবাদ পান এবং দেখেন পুত্র স্থানীয় আদিবাসীদের দ্বারা পালিত হচ্ছে। রাজা জগৎ সিংহ তখন কুমারকে ঐ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ রাজা ঘোষনা করে নিজ রাজত্বে (রাজস্থানের ধার রাজ্য) গমন করেন, এবং কুমারের বয়ঃপ্রাপ্তির পর ফিরে এসে স্থানীয় অধিবাসীদের একত্রিত করে পুত্র দামোদর সিংহের রাজ্যভিষেক করেন। কিন্তু ততদিনে সেই বয়স্ক স্থানীয় আদিবাসীরা সকলেই মৃত। সেই মানুষগুলির উপকার এবং সততার পুরস্কার স্বরূপ রাজা ওই সাতজন স্থানীয় অধিবাসীকে ‘রাণা’ নামে ভূষিত করেন। ভারতের ইতিহাসে পঞ্চকোট রাজপরিবারই প্রথম এইভাবে মরনোত্তর পুরস্কার প্রচলিত করেন। এখনো পর্য্যন্ত রাজপরিবারের কোন অনুষ্ঠানে ওই সাতজন রাণার নামে একটি নতুন মাটির হাঁড়িতে কলাই এর ডাল ও চালের খিচুড়ি রান্না করে স্থানীয় কোন পুকুরের পাড়ে নিবেদন করা হয়। ওই সাতজন স্থানীয় আদিবাসীদের প্রতি এভাবেই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয়।
পঞ্চকোট রাজপরিবারের রাজধানী কিন্তু বারে বারেই তার স্থান পরিবর্তন করেছে। মধ্যপ্রদেশের উজ্জ্বয়িনীর ধারনগর থেকে যাত্রা শুরু করে ঝালদা, পাড়া হয়ে গড়পঞ্চকোট তারপর সেখান থেকে মহারাজনগর, রামবনি, কেশরগড় হয়ে কাশীপুরে তার যাত্রা শেষ হয়।
ইতিহাস বলছে, ১৮৩২ সালে পঞ্চকোট রাজ জগজীবন সিংহ দেও হুড়ার কেশরগড় থেকে রাজধানী দ্বারকেশ্বর নদের গাঁ ঘেষা কাশীপুরে তুলে নিয়ে আসেন । কাশীপুরে এই বংশের সাতজন রাজা রাজত্ব করলেও রাজা নীলমণি ও জ্যোতিপ্রসাদের নামই ইতিহাসের পাতায় বারবার উঠে আসে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় নীলমণি সিংহ দেও-র নেতৃত্বেই পুরুলিয়া ট্রেজারি লুঠ হয়েছিল। পুরুলিয়া জেল ভাঙা আন্দোলনেরও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। জেল ভেঙে ৬৩ জন কয়েদিকে মুক্ত করা হয়।
তখন তিনমাস পুরুলিয়া ব্রিটিশ-প্রশাসন মুক্ত ছিল। পরে পুলিশ নিয়ে এসে ক্যাপ্টেন ওকস নীলমণিকে গ্রেফতার করেন। কাশিমবাজারের রানি স্বর্ণময়ী পঞ্চকোট রাজ্যের ৪৪টি মৌজার বিনিময়ে নীলমণিকে জামিনে মুক্ত করেন । কারামুক্ত হয়েই তিনি পঞ্চকোটে সাংস্কৃতিক নবজাগরণ আনেন। বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত সঙ্গীত অধ্যাপক জগচ্চন্দ্র গোস্বামী, মৃদঙ্গবাদক হারাধন গোস্বামী, বংশীবাদক পূরণ সিংহ চৌতাল বা নবদ্বীপের ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন, নৈয়ায়িক পার্বতীচরণ বাচস্পতি, কেদার ন্যায়রত্ন প্রমুখের মতো পণ্ডিতদের নিয়ে তিনি তাঁর নবরত্ন সভা চালু করেন।
রাজা নীলমণির সেই ধারা পেয়েছিলেন রাজা জ্যোতিপ্রসাদ। তাঁর রাজ্যের অন্তর্গত ধানবাদ-আসানসোল এলাকায় পরবর্তীকালে মাটির নীচ থেকে কয়লা বের হওয়ায় তার ‘রয়্যালটি’ পান জ্যোতিপ্রসাদ। আর তা থেকেই তিনি তার রাজ্যকে নিজের মতো করে সাজিয়েছিলেন। কাশীপুরে বর্তমান যে সুদৃশ রাজবাড়ি রয়েছে, তা জ্যোতিপ্রসাদেরই তৈরি। ১৯১৬ সালে এই রাজবাড়ি তিনি তৈরি করেন চিন থেকে রাজমিস্ত্রি এনে। টানা ১২ বছর ধরে চলেছিল নির্মাণ কাজ। বেলজিয়াম থেকে বিশাল ঝাড়লন্ঠন নিয়ে এসে লাগিয়েছিলেন প্রাসাদের দরবার হলে।
তবে রাজবাড়িতে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ওই বাড়িতেই রাজ পরিবারের বর্তমান বংশধররা থাকেন। শুধু পুজোর সময় রাজবাড়ির একাংশ সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
গড়পঞ্চকোটের স্থাপত্য
গড় পঞ্চকোটের অধিকাংশ স্থাপত্য বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত বা অবলুপ্তির পথে। এই স্থানে বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে, যেগুলি উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
তোরণ
১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে জে ডি বেগলার গড় পঞ্চকোট ভ্রমণ করে আঁখ দুয়ার, বাজার মহল দুয়ার, খড়িবাড়ি দুয়ার এবং দুয়ার বাঁধ নামক চারটি তোরণের বর্ণনা করেন। তিনি দুয়ার বাঁধ ও খড়িবাড়ি দুয়ারের গায়ে উৎকীর্ণ লিপিতে মল্লরাজ বীর হাম্বিরের নামের উপস্থিতি লক্ষ্য করেন, যা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে পঞ্চকোট রাজ্য মল্লভূমের অধীনস্থ হয়েছিল।
পঞ্চরত্ন মন্দির
গড় পঞ্চকোটের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য মন্দির হল একটি পঞ্চরত্ন টেরাকোটা নির্মিত দক্ষিণ ও পূর্বদুয়ারী রাস মন্দির। মন্দিরের গায়ে ফুল ও আলপনার নকশা ছাড়াও খোল, করতাল বাদনরত ও নৃত্যরত মানব-মানবীর মূর্তি পরিলক্ষিত হয়। ষাট ফুট উচ্চ কেন্দ্রীয় চূড়া বিশিষ্ট ভগ্নপ্রায় এই মন্দিরে কোন বিগ্রহ নেই। উত্তরপশ্চিম দিকে অপর একটি পঞ্চরত্ন টেরাকোটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, বর্তমানে যার চারটি চূড়া নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ও মধ্যের ৪০ ফুট উচ্চ চূড়াটি অবশিষ্ট রয়েছে।
কঙ্কালী মাতার মন্দির
গড়ের পশ্চিমদিকে প্রস্তর নির্মিত কঙ্কালী মাতার ভগ্নপ্রায় মন্দিরের অস্তিত্ব বর্তমান। মন্দিরের সামনের অংশ অক্ষত হলেও পেছনের অংশ সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত। কঙ্কালী মাতা পঞ্চকোট রাজ্যের কুলদেবী হলেও বর্তমানে এই মন্দিরে কোন বিগ্রহ নেই। মন্দিরের প্রবেশপথের ওপরে কোন লিপি বা মূর্তি খোদিত ছিল, যা বর্তমানে বিনষ্ট হয়েছে।
বিবিধ আছিল পুণ্য তোর জন্মান্তরে,
তেঁই দেখা দিলা তোরে আজি হৈমবতী
যেরূপে করেন বাস চির রাজ-ঘরে
পঞ্চকোট;-পঞ্চকোট—ওই গিরিপতি।
পঞ্চকোট রাজবংশের নির্মিত বহু স্থাপত্যের নিদর্শন পুরুলিয়া বা তার পার্শবর্তী অঞ্চলে পাওয়া যায়। তার মধ্যে অন্যতম মাতা কল্যানেশ্বরীর মন্দির।এই মন্দির নির্মান নিয়ে অনেক অলৌকিক গল্প প্রচলিত আছে।অনেকে বলেন পঞ্চকোট রাজবংশের রাজা কল্যাণশেখরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বল্লাল সেনের পালিতা কন্যা সাধনার। বাপের বাড়িতে সাধনা প্রতিদিন কুলদেবী শ্যামারূপার সেবা না করে জলস্পর্শ করতেন না। তাই তিনি বিয়ের পরে বাবার কাছে শ্যামারূপা দেবীকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করেন। আদরের দুলালী সাধনার প্রার্থনা শুনে বল্লাল সেন বিচলিত হলেও নামঞ্জুর করতে পারেন না। তিনি মায়ের মুর্তি আর সঙ্গে একটি কালো রঙের ঘোড়া দিয়ে মেয়ে জামাইকে বিদায় দেন। এবং বারংবার সাবধান করে দেন মুর্তি যেনো কোন কারনেই মাটিতে রাখা না হয়।পথে ক্লান্ত নবদম্পতি একটু বিশ্রামের আশায় দেবীকে একটি গুহার মধ্যে থেকে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। বিশ্রামের পর যাত্রা শুরু করতে গিয়ে হল বিপদ। অনেক চেষ্টা করেও দেবীমূর্তি নড়ানো গেল না। সাধনা নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঠিক করলেন তিনি তার নিজের প্রাণ বিসর্জন দেবেন। সহধর্মিণীর কথা শুনে কল্যাণশেখরও আত্মাহুতি দেবেন বলে ঠিক করলেন।
কথিত আছে সেই সময়েই নাকি দেবী তাঁদের দেখা দেন। কেউ আবার বলেন তারা যখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তখন স্বপ্নে দেবী তাঁদের দেখা দেন। দেবী নির্দেশ দেন, ‘‘আমি এখানেই (মোচলপুর) থাকব। নাম হবে কল্যাণেশ্বরী। আর শ্বশুরবাড়িতে ফিরে গিয়ে তুই আমার চর্তুভুজা মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিস। ওখানে আমার নাম হবে রাজরাজেশ্বরী।’’
এইভাবে ইতিহাস আর প্রকৃতি আর লোকগল্প যেন একে অপরের হাত ধরাধরি করে রয়েছে এই বংশের অলিতে গলিতে। কিন্তু সরকারের উদাসীনতায় হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস — হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ। দেউলগুলির এতটাই জীর্ণ দশা যে, যেকোনও সময় ভেঙে যাবে। ইতিহাস বলে পঞ্চকোট পাহাড় জুড়ে প্রচুর গাছ লাগিয়েছিলেন রাজারা। শাল, পিয়াল, মহুয়া’র পাশাপাশি গুলঞ্চ, বহড়া, নিম, আমলকি, হরিতকী প্রভৃতি গাছ রয়েছে পাহাড় জুড়ে। যদিও বন দপ্তরের অদূরদর্শীতায় রাতের অন্ধকারে প্রায়শই গাছ কাটা চলছে। পুরোনো ইতিহাসের পাতা হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের লোভ, উদাসীনতা আর অজ্ঞতার অন্ধকারে।মাইকেলের ভাষাতেই তাই উপসংহার টেনে বলি
কোথায় সে রাজলক্ষ্মী, যাঁর স্বর্ণ-জ্যোতি
উজ্জ্বলিত মুখ তব ? যথা অস্তাচলে
দিনান্তে ভানুর কান্তি । তেয়াগি তোমায়
গিয়াছেন দূরে দেবী, তেঁই হে ! এ স্থলে,
মনোদুঃখে মৌন ভাব তোমার ; কে পারে
বুঝিতে, কি শোকানল ও হৃদয়ে জ্বলে?
মণিহারা ফণী তুমি রয়েছ আঁধারে।
কীভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে ট্রেনে গিয়ে নামতে পারেন বরাকর, অথবা কুমারডুবি অথবা আদ্রা স্টেশনে। বরাকর থেকে গড় পঞ্চকোটের দূরত্ব ১৯ কিমি। কুমারডুবি থেকে দূরত্ব ১৪ কিমি। আদ্রা থেকে দূরত্ব ২৫ কিমি। এই তিন স্টেশন থেকেই অটো ভাড়া করে পৌঁছে যান গড় পঞ্চকোটে। কুমারডুবি সবচাইতে কাছে কিন্তু যোগাযোগ ভালো বরাকর বা আদ্রা কিংবা আসানসোল (৪৯ কিমি) থেকে।
আগে থেকে গাড়ি বুক করে রাখলে তাতেও সওয়ারি হতে পারেন।
রেলপথ ছাড়াও সড়ক পথে NH-2 ধরে, আসানসোল থেকে দিশেরগড় হয়ে চিরকুন্ডা রোড ধরে পৌঁছে যেতে পারেন গড় পঞ্চকোটে।
কোথায় থাকবেন
গড় পঞ্চকোটে রাত্রিবাসের সেরা ঠিকানা পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের বাংলো, ভাড়া- ১,৫০০-৪,৫০০ টাকার মধ্যে। যোগাযোগ- ০৩৩-২৩৩৫০০০৬৪।
Comments
Post a Comment