স্ব_Car_এ_ঘুরোঘুরি
'এবারের পুজোর ট্রিপটা নিয়ে কিছু ভাবলে' -পুজোর ঠিক এক সপ্তাহ আগে আচমকাই বাউন্সারটা ধেয়ে এলো গিন্নীর কাছ থেকে।সত্যি বলতে কি অনেকদিন ধরেই এই বাউন্সারটা আশা করছিলাম কারন বিগত বছরগুলোতে জানুয়ারী থেকে অক্টোবরের মধ্যে বড় ছোটো মিলিয়ে প্রায় চার পাঁচটা ট্রিপ হয়ে যায় কিন্তু এই বছর বিভিন্ন কারণবশত সেভাবে বেরনোই হয়নি। আর পুজোর ছুটিতেও সেরকম কোন প্ল্যান করে ওঠা হয় নি। সুতরাং বাউন্সারটা আসাই স্বাভাবিক আর এই অবস্থায় এধরনের বাউন্সার গুলো সাধারণত ডাক করে দেওয়ার নিয়ম, কিন্তু কি ভিমরতি হলো সপাটে হুক করে বল্লাম, ব্যাগ গোছাও, চলো,দেবভুমি যাবো।হিমালয়ের কুমায়ুন আর গাড়োয়াল এই দুই পাহাড়ি এলাকা নিয়ে আজকের উত্তরাখণ্ড,আমাদের অতিপ্রিয় দেবভূমি। বিশ্বাসীর জন্য একরকম সৌন্দর্য আর অবিশ্বাসীর জন্য আর একরকম। বিধাতা এখানে প্রকৃতিকে ঢেলে সাজিয়েছেন। অজস্র নদী, ঝরনা, সবুজ বনানী, বুগিয়াল, ফুল আর পাখিতে সুসজ্জিতা প্রকৃতি যার প্রায় প্রতিটি স্থানের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ঝুড়ি ঝুড়ি পৌরাণিক ও মহাভারতের গল্প।
অক্ষয় তৃতীয়াতে মাথার উপর ঝুলে থাকা চাঁদবুড়িটা যখন বাঁকা কাস্তের মত ধারালো হয়ে ওঠে তখনই ভারতবর্ষের মাথার উপর সটান দাঁড়িয়ে থাকা হিমালয়ের এই দেবভূমিতে বরফের ঘুম ভেঙ্গে জেগে ওঠে হিন্দুধর্ম বিশ্বাসীদের পবিত্র তীর্থ চারধাম। গঙ্গোত্রী, যমুনাত্রী, কেদারনাথ ও বদ্রীনাথ। জেগে ওঠে দেবাদিদেব মহাদেবের পঞ্চকেদার,যথা.... কেদারনাথ,মদমহেশ্বর, কল্পেশ্বর, রুদ্রনাথ আর তুঙ্গনাথ। হিন্দু ধর্মে পূরান মতে যে ব্যাক্তি এই চারধাম যাত্রা সম্পুর্ণ করে সে সমস্ত পাপ থেকে মুক্তি পায় ও জীবন মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করে।
তা আমি মশাই নাস্তিক মানুষ। তীর্থের থেকে এডভেঞ্চারের নেশাই আমাকে বেশি টানে। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে যে নিঃসঙ্গ ভালবাসা লুকিয়ে থাকে তাকে অনুভব করার আকুতি আর ঈশ্বরকে স্পর্শ করার অনুভূতি দুটোই আমার কাছে সমান লাগে। তাই খরস্রোতা, তীব্রবেগে ধাবমান আঁকাবাঁকা গঙ্গার ধারাকে পাশে রেখে,পাহাড়ী রাস্তায় গাড়ি চালানোর আমোঘ আকর্ষন, মনের এক কোনায় চারধাম দর্শনের একটা সুপ্ত বাসনা, মানসিক ও আধ্যাত্মিক শান্তির খোজ এবং মুফতে কিছু পূন্য অর্জনের লোভে স্ব-car এ চারধামের মুখ্যদ্বার হরিদ্বারের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরলাম।সনাতন বৌদ্ধ ধর্ম মতে পরিক্রমা করতে হয় বামদিক থেকে ডানে, তাই ঠিক করলাম যমুনেত্রী দিয়ে শুরু করে বদ্রীনাথে গিয়ে শেষ করবো আমাদের যাত্রা,যদিও সেরকম কোন কংক্রিট প্ল্যান কিছু ছিলো না,কারন বিগত বহু রোডট্রিপের অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বুঝেছি you never know what may be your next destination.তাই রোডট্রিপে বেড়িয়ে আমরা সাধারণত অত আগাম প্ল্যান পোগ্রাম করি না।গাড়ি চালাতে চালাতেই আমাদের পরের দিনের itinerary বানাই, রাস্তার ধারে ধাবায় বসে চা খেতে খেতে রাস্তার সুলুকসন্ধান নিই,হোটেল না পেলে গাড়িতে ঘুমাই, মানে যাকে বলে ভ্রমনের স্বাধীনতাটা চেটেপুটে উপভোগ করি।
*যাত্রা শুরু - প্রথম দিন -
আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থল লক্ষ্ণৌ। রুটটা নিয়ে আমি বহুবার বহু ফোরামে লিখেছি তাই আর চর্বিতচর্বন করলাম না। যেহেতু প্রায় ১০০০ কিমি যাত্রা এবং প্রায় ১৮ -২০ ঘণ্টা টানা ড্রাইভ করতে হবে তাই আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম নাইট ড্রাইভ করবো। সেইমত ঠিক সকাল ৯ টা নাগাদ গাড়ি স্টার্ট দিলাম। পুজোর টাইম তাই ডানলপ হয়ে ডানকুনি ঢুকতে বেশ বেগ পেতে হলো, তারপর মাখনের মতো রাস্তা, গড়ের মাঠের মত ফাঁকা NH, ১২০ এভারেজে হাইওয়ে ড্রাইভ, অল্পেতে স্বাদ মেটে না,এ স্বাদের ভাগ হবে না❤❤।
গাড়িটা চলুক ততক্ষন আমি আমার টিমের সাথে পরিচয়টা করিয়ে দি। বরাবরের মতোই এবারো আমার টিমটা একদমই ছোট - আমি,আমার গিন্নী,আমার দশ বছরের একমাত্র দামাল কন্যা,যে পুরো ট্রিপে আমার নেভিগেটরের দায়িত্ব খুব সুচারু ভাবে সামলেছে এবং আমার শ্বাশুড়ীমা। এদের সকলের মানসিক সমর্থন ছাড়া হয়তো এতবড় ট্রিপ করা আমার পক্ষে সম্ভবই হতো না।আমরা প্রথম পিট স্টপ নিলাম তোপচাঁচি পেড়িয়ে একটা রিলায়েন্সের পেট্রোল পাম্পে। প্রায় ৩০০ কিমি একটানা চালানোর পর পেটে তখন ছুঁচোর ডনবৈঠক শুরু হয়ে গেছে। বাহনকে পেটপুরে খাইয়ে আমরাও সঙ্গে আনা লাঞ্চপ্যাকেট দিয়ে পেটপুজোটা সেরে ফেললাম। তারপরের স্টপটাও বেশ অনেকটাই দূরে, বেনারস পেড়িয়ে আমরা একটি ধাবায় দাড়িয়ে হালকা কিছু ডিনার করে নিলাম। বস্তুত বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই চান্দৌলি থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ চলছে ফলে মাঝে মাঝেই আমাদের কিছু অপ্রীতিকর জ্যাম ও ডাইভার্সানের মুখোমুখি হতে হয়,যা,এসব লং ড্রাইভের ক্ষেত্রে খুব বিরক্তিকর লাগে।যদিও রাত ১০টা নাগাদ এলাহাবাদ বাইপাসে ওঠার পর আবার ৬লেন রাস্তা পেয়ে গেলাম।রায়বেরিলিতে ঢোকার মুখে দেখি একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে, গাড়িটা সোজা একটা ধাবায় ঢুকিয়ে দিয়ে টান টান হয়ে খাটিয়ায় শুয়ে একটা কড়া চায়ের অর্ডার দিলাম।উত্তরের শীতটা বেশ ভালোই মালুম পাচ্ছিলাম। নাইট ড্রাইভ করার ফাঁকে চাঁদনি রাতে ( চাঁদ থাকুক বা না থাকুক ভেবে নিতে ক্ষতি কি) শীতের আমেজে ধাবার খাটিয়ায় শুয়ে চা যারা খাননি তারা জীবনে অন্তত একবার এটা ট্রাই করে দেখতে পারেন, এ এক আশ্চর্য অনুভূতি। মনে হবে যেন রাতের তারারা থম মেরে বসে আপনার গল্প শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
রাতদুপুরে যে যার মত সবাই নি:সঙ্গ
চাঁদ তারাদের চলে রাতজুড়ে রঙ্গ ।
মাঝে মাঝে নিভে যায় চাঁদের উজ্জ্বল শিখা
আকাশটা ঢেকে দেয় অবাঞ্চিত কুহেলিকা ।
আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থল লক্ষ্ণৌ। রুটটা নিয়ে আমি বহুবার বহু ফোরামে লিখেছি তাই আর চর্বিতচর্বন করলাম না। যেহেতু প্রায় ১০০০ কিমি যাত্রা এবং প্রায় ১৮ -২০ ঘণ্টা টানা ড্রাইভ করতে হবে তাই আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম নাইট ড্রাইভ করবো। সেইমত ঠিক সকাল ৯ টা নাগাদ গাড়ি স্টার্ট দিলাম। পুজোর টাইম তাই ডানলপ হয়ে ডানকুনি ঢুকতে বেশ বেগ পেতে হলো, তারপর মাখনের মতো রাস্তা, গড়ের মাঠের মত ফাঁকা NH, ১২০ এভারেজে হাইওয়ে ড্রাইভ, অল্পেতে স্বাদ মেটে না,এ স্বাদের ভাগ হবে না❤❤।
গাড়িটা চলুক ততক্ষন আমি আমার টিমের সাথে পরিচয়টা করিয়ে দি। বরাবরের মতোই এবারো আমার টিমটা একদমই ছোট - আমি,আমার গিন্নী,আমার দশ বছরের একমাত্র দামাল কন্যা,যে পুরো ট্রিপে আমার নেভিগেটরের দায়িত্ব খুব সুচারু ভাবে সামলেছে এবং আমার শ্বাশুড়ীমা। এদের সকলের মানসিক সমর্থন ছাড়া হয়তো এতবড় ট্রিপ করা আমার পক্ষে সম্ভবই হতো না।আমরা প্রথম পিট স্টপ নিলাম তোপচাঁচি পেড়িয়ে একটা রিলায়েন্সের পেট্রোল পাম্পে। প্রায় ৩০০ কিমি একটানা চালানোর পর পেটে তখন ছুঁচোর ডনবৈঠক শুরু হয়ে গেছে। বাহনকে পেটপুরে খাইয়ে আমরাও সঙ্গে আনা লাঞ্চপ্যাকেট দিয়ে পেটপুজোটা সেরে ফেললাম। তারপরের স্টপটাও বেশ অনেকটাই দূরে, বেনারস পেড়িয়ে আমরা একটি ধাবায় দাড়িয়ে হালকা কিছু ডিনার করে নিলাম। বস্তুত বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই চান্দৌলি থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ চলছে ফলে মাঝে মাঝেই আমাদের কিছু অপ্রীতিকর জ্যাম ও ডাইভার্সানের মুখোমুখি হতে হয়,যা,এসব লং ড্রাইভের ক্ষেত্রে খুব বিরক্তিকর লাগে।যদিও রাত ১০টা নাগাদ এলাহাবাদ বাইপাসে ওঠার পর আবার ৬লেন রাস্তা পেয়ে গেলাম।রায়বেরিলিতে ঢোকার মুখে দেখি একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে, গাড়িটা সোজা একটা ধাবায় ঢুকিয়ে দিয়ে টান টান হয়ে খাটিয়ায় শুয়ে একটা কড়া চায়ের অর্ডার দিলাম।উত্তরের শীতটা বেশ ভালোই মালুম পাচ্ছিলাম। নাইট ড্রাইভ করার ফাঁকে চাঁদনি রাতে ( চাঁদ থাকুক বা না থাকুক ভেবে নিতে ক্ষতি কি) শীতের আমেজে ধাবার খাটিয়ায় শুয়ে চা যারা খাননি তারা জীবনে অন্তত একবার এটা ট্রাই করে দেখতে পারেন, এ এক আশ্চর্য অনুভূতি। মনে হবে যেন রাতের তারারা থম মেরে বসে আপনার গল্প শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
রাতদুপুরে যে যার মত সবাই নি:সঙ্গ
চাঁদ তারাদের চলে রাতজুড়ে রঙ্গ ।
মাঝে মাঝে নিভে যায় চাঁদের উজ্জ্বল শিখা
আকাশটা ঢেকে দেয় অবাঞ্চিত কুহেলিকা ।
দ্বিতীয় দিন ঃ - #নবাবী_শহরের_অলিগলিতে
'লখ্-নউ হম্ পর ফিদা হ্যায়
হম্ হ্যায় ফিদায়ে লখ্-নউ’।
ঠিক ভোর ছটায় হোটেলের সামনে পৌছে গেলাম। Payment @hotel এই শর্তে Fabhotel app এর মাধ্যমে বুকিং তাই বুকিং নিয়ে খুব একটা আশাবাদী ছিলাম না তবে হোটেলে পৌঁছে দেখলাম বুকিংটা করে খুব একটা ভুল করিনি।
একটু রেস্ট নিয়ে হোটেল থেকে বেরতেই কে যেন কানে কানে ফিসফাস করে বলে উঠলো - 'আপ লাখনাওমে আ গয়ে হ্যায় জনাব, যারা তসরিফ রাখিয়ে'।সত্যিই তো তুমি লক্ষ্মৌ বললে আর আমি শুনলাম বাইজীর ঘুঙরুর ছমছম... ঠমক ছমক... তুন্ডে-গলৌটি-বোটি কাবাবের সঙ্গে বিরিয়ানীর যুগলবন্দী...রুহ খস আর গুল-এর খুশবুতে মাতোয়ারা দিল... গলিতে গলিতে কালো চোখের গভীর চাহনিতে মাতাল করা সেই সুর ‘চলতে চলতে/ ইঁয়ুহি কোয়ি মিল গয়া থা/ সার-এ-রাহ্ চলতে চলতে’... শুধু লক্ষ্মৌ নিয়ে লিখতে গেলেই রাত কাবার হয়ে যাবে।তেহজিব আর তমিজ শব্দদুটির বা বাংলায় যাকে বলে শিষ্টাচার আর বিনয়ের এক অসাধারণ যুগলবন্দির নমুনা মেলে এই ঐতিহাসিক শহরটিতে।
লক্ষ্মৌর রাস্তায় বেরোলেই আমার কেমন জানি খিদে খিদে পায়। তার ওপর সারারাত গাড়ি চালানোর ধকল তাই এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা 'দস্তরখান'(খ্বান মানে থালা বা ট্রে। পহ্লবী শব্দ। এরথেকে দস্তরখ্বান বা দস্তরখান।) এর সামনে গাড়ি পার্ক করলাম।ওখানে উলটে তাওয়া কি পরোটা আর গলৌটি কাবাব খেতে খেতে মেয়ের সামনে ইতিহাসের প্যান্ডোরা খুলে বসলাম।১৭৩২ সালে সাদাত আলি খাঁ অওধের তখতে নবাব হয়ে বসেন। তাঁরই বংশের সবচেয়ে উজ্জ্বল কীর্তির মানুষ নবাব আসাফ-উদ-দৌল্লা ১৭৭৫ সালে ফৈজাবাদ থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে আসেন এই শহরে।
এই ঐতিহাসিক শহরটার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে নবাব আসফ-উদ-দৌলার নাম। যদিও নগরীর উত্পত্তি ও নামকরণ নিয়ে বিতর্ক কখনই লক্ষৌ-এর পিছু ছাড়েনি।
লক্ষৌ-এর নামকরণের পৌরাণিক কাহিনী কী বলে? রামায়ণে উল্লেখ রয়েছে, রামচন্দ্রের বনবাসের পর তিনি লক্ষ্মণের হাতে তুলে দিয়েছিলেন এই অঞ্চল। রামানুজ লক্ষ্মণের নাম অনুসারে এর নাম হলো লক্ষ্মনাবতী। এবং ক্রমে অপভ্রংশ হয়ে লক্ষৌতে রূপান্তরিত হলো। আর ভিন্ন একটি মত বলছে: জৌনপুরের মুসলিম শাসক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই নগরী। তার নির্দেশে হিন্দু স্থপতি লখনা নির্মাণ করেন একে। সেই স্থপতি লখনার নামই পরিবর্তিত রূপ নিয়ে লক্ষৌ হয়ে বেঁচে আছে নগরীর জৌলুসময় আবেদনের মধ্যে। যদিও নামের এই ঐতিহাসিক বিতর্কের কোনটিই চূড়ান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পায়নি।
১৭৮৪তে সারা উত্তর ভারত যখন দুর্ভিক্ষে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, চারিদিকে উঠছে মানুষের হাহাকার, নবাব আসাফ-উদ-দৌল্লা তাঁর রাজ্যের আর্ত মানুষদের সাহায্য করার জন্য শুরু করেন এক বিশাল নির্মাণ।
নবাব আসাফুদ্দৌল্লার ইচ্ছা ছিল বড় ইমামবাড়ার স্থাপত্য যেন তৎকালীন হিন্দুস্থানের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হয়। তিনি আজিব-এ-ঘারিব ...বিস্ময়কর ইমারত নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। বড় ইমামবাড়া নির্মাণ করার জন্য তৎকালীন হিন্দুস্থানের সমস্ত তাবড় তাবড় স্থপতিদের আউধের দরবারে ডাকা হয়েছিল। নবাবের কাছে দেশের সব স্থপতিদের পেশ করা নকশার মধ্যে কিফায়াতুল্লাহর পেশ করা নকশাটি বাদশাহের সেরা মনে হয়েছিল এবং তিনি নকশাটিকে বড় ইমামবাড়ার জন্য নির্বাচিত করেছিলেন। কিন্তু আকারে ও আয়তনে এত বড় স্থাপত্যের জন্য জমি নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে বহু খোঁজাখুজির পাওয়া গেল একটি জমি, কিন্তু তাতেও সমস্যা দেখা দিল। জমিতে রয়েছে একটি পর্ণকুটির এবং সেখানে বাস করেন এক বৃদ্ধা নাম... লাডো-সাকুম।
ইমামবাড়া নির্মাণ করতে হলে ওই কুটিরটিকেই সরাতে হয়। নবাব চাইলেই ওই জমি জোর করে কেড়ে নিতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করলেন না। তিনি লোক পাঠালেন বৃদ্ধার কাছে ... বৃদ্ধা যা চাইবেন নবাব তাই দিতে রাজি, শুধু জমিটি ছেড়ে দিতে হবে। বৃদ্ধা লাডো-সাকুম জানালেন তিনি এই স্থানে হাসান-হোসেনের তাজিয়া প্রতিষ্ঠা করেছেন সুতরাং তিনি এই স্থান ছাড়তে পারবেন না। খবর পৌঁছালো নবাবের কাছে। নবাব আসাফুদ্দৌল্লা প্রতিশ্রুতি দিলেন, বৃদ্ধা লাডো-সাকুম যেখানে তাজিয়া প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেখানেই তাজিয়া প্রতিষ্ঠিত করা হবে এবং একই দিনে তা কারবালায় নিয়ে যাওয়া হবে। বৃদ্ধা রাজী হলেন জমি ছেড়ে দিতে। নবাব তাকে ইনাম দিতে চাইলে বৃদ্ধা তা প্রত্যাখান করেন। তিনি নবাবের লোককে জানিয়ে দেন... একটি মহৎ কাজের জন্য তিনি জমি দান করেছেন, তার ইনাম লাগবে না।
নবাব কথা রেখেছিলেন... বড় ইমামবাড়ায় একটি মাত্র কাঠের দরজা যুক্ত একটি কক্ষ আছে যেখানে ওই বৃদ্ধার প্রতিষ্টিত তাজিয়াটি রাখা আছে এবং এখনও মহররমের দিন বড় ইমামবাড়া থেকে প্রথমে বৃদ্ধার তাজিয়া বেড়োয় তারপর মূল তাজিয়ার শোভাযাত্রা শুরু হয়।
বড় ইমামবাড়ার নির্মাণ শেষ হয়ে গেলে, উদ্বোধনের দিন নবাব কিফায়াতুল্লাহর কাছে জানতে চেয়েছিলেন...
তুমি কি ইনাম চাও?
জবাবে কিফায়াতুল্লাহ নাকি উত্তর দিয়েছিলেন...
-নবাব, হুজুর, আল্লাহ মালিক, হামকো দো-গজ জমিন চাহিয়ে ..
খুশি হয়েছিলেন নবাব এখনও বড় ইমামবাড়ায় শায়িত আছে তার দেহ। নির্মাণ করা হয়েছে তার জন্য নির্দিষ্ট কবর।শোনা যায়, এই নির্মানকার্যে দিনের বেলায় খাদ্যের বিনিময়ে গরীব মানুষেরা এসে কাজ করতেন আর রাতে তাঁদের সঙ্গেই মিশে যেতেন শহরের অভিজাতরা, যাঁদেরও সংসার সমানভাবেই ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়েছিল। দিনরাত কাজ হত। প্রতিদিন প্রায় কুড়ি হাজার মানুষ নাকি এই নির্মাণে হাত লাগিয়েছিলেন। এইভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল ‘আসাফি ইমামবাড়া’ বা 'বড়া ইমামবাড়া'। এই অসাধারণ উদ্যোগটি নবাবকে তুমুল জনপ্রিয় করেছিল তাঁর প্রজাদের কাছে আর চালু হয়েছিল একটি কথা, ‘যিসকো ন দে মওলা/ উসকো দে আসাফ-উদ-দৌল্লা’।
এক কোটি টাকা খরচ করে ১৭৯২ সালে শেষ হয় এই ইমামবাড়া তৈরির কাজ। ইমামবাড়ার কেন্দ্রীয় অংশটি ১৬৩ ফুট দীর্ঘ আর ৫৩ ফুট চওড়া। ৫০ ফুট উচ্চতার ভরহীন ছাদটি হল এই ইমামবাড়ার এমন এক বৈশিষ্ট্য, যা দেখে আজও তাক লেগে যায়। পুরো হলটির মাঝখানে কোন স্তম্ভ নেই, ছাদ ধরে রাখার জন্য।এই প্রাসাদেরই নিচতলায় দরবার ঘরে সমাধিস্থ রয়েছেন নবাব আসফ-উদ-দৌলা ও তাঁর প্রিয়তমা পত্নী। এ কারণে বড় ইমামবাড়ার মূল চত্বরে ঢোকার আগে জুতা খুলে রেখে যেতে হয়। তবে এই ইমামাবাড়ার আসল চমক কিন্তু ইমামবাড়ার ওপরের তলায়।
একদম ওপর তলায়, “এদিক ওদিক এঁকেবেঁকে সুড়ঙ্গ চলে গেছে"। সেগুলো এমন কায়দায় তৈরি যে, যতবারই এক একটা মোড় ঘুরছি, ততবারই মনে হচ্ছে যেন যেখানে ছিলাম সেখানেই আবার ফিরে এলাম। একটা গলির সঙ্গে আরেকটা গলির কোন তফাৎ নেই - দুদিকে দেয়াল, মাথার ওপর নিচু ছাত, আর দেওয়ালের মাঝখানটায় একটা করে খুপ্রি। গাইড বলল, নবাব যখন বেগমদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতেন, তখন ঐ খুপরিগুলোতে পিদিম জ্বলত। রাত্তিরবেলা যে কী ভূতুড়ে ব্যাপার হবে সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। গোলকধাঁধার শেষ গলিটার শেষে যে দরজা আছে, সেটা দিয়ে বেরোলেই ইমামবাড়ার বিরাট ছাতে গিয়ে পড়তে হয়। গিয়ে দেখি সেখান থেকে সমস্ত লখ্নৌ শহরটাকে দেখা যায়।ভুলভুলাইয়াতে ঘুরতে ঘুরতে বড়া ইমামাবাড়ার কেন্দ্রীয় হলের দোতলার ভেতরের বারান্দায় যখন উপস্থিত হবেন, গাইড চলে যাবে আপনার থেকে অন্তত ৫০ ফুট দূরে। তারপর এক মজা। দেওয়ালে মুখ লাগিয়ে কি যেন বলবেন গাইড। ৫০ ফুট দূরে থাকা আপনি যেই দেওয়ালে কান রাখবেন, শুনতে পাবেন গাইডের ফিসফিস করে বলা কথাগুলি। আজ্ঞে হ্যাঁ, এখানে দেওয়ালেরও কান আছে।এর দেয়াল তৈরি তে কয়লা র মিশ্রন ব্যাবহার করা হয়েছে , এতে করে প্রাসাদ এর যে কোন পাশে কিছু বললে, অন্য পাশে সেটা শুনতে পাওয়া যায়। আমাদের বর্ণনা কারি গাইড এর ভাষ্য অনুযায়ী , প্রাসাদ এর প্রহরীরা যাতে কোন ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে না পারে , তার জন্য এই নিরাপত্তা ...
বড়া ইমামাবাড়ার সামনেই রাস্তার ওপর রুমি দরওয়াজা। ইস্তানবুলের বিখ্যাত একটি দরওয়াজার অনুকরণে এটি তৈরি। চুনামাটির ফ্রিলের কাজ, গায়ে গুলদস্তা বা কুঁড়ি। একটু দূর থেকে দেখলে মনে হবে পদ্ম।
এখানেই দেখা হয়ে গেলো আমাদের গ্রুপের আর এক সদস্য অনিন্দ্যদার সাথে। উনিও তার পরিবারের সাথে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরেছিলেন।
এরপরের গন্তব্য ছোটা ইমামাবাড়া। ১৮৩৭ সালে নিজের স্মৃতিসৌধ হিসাবে এটি তৈরি করেন আদিল শাহ। প্রাসাদের ভেতরটা এখন খুবই শান্ত, একেবারে যাকে বলে পিনপতন নিস্তব্ধতা। অনিন্দ্য সুন্দর সব ঝাড়বাতি ও আরো নানা আলোর বাতি, গিল্টি করা আয়না আর দেওয়ালে চারুময় কারুকাজ দেখে যে কারো চক্ষুস্থির হয়ে যাবে। এই প্রাসাদের কয়েকটি গম্বুজের মধ্যে বড় গম্বুজটি সোনার, অন্তত ওতে সোনার কারুকাজ রয়েছে এমন জনপ্রিয় বহুলশ্রুত জনশ্রুতি রয়েছে। মহরম উৎসবের সময় প্রাসাদের সব ঝাড় লক্তন আর আলোর বাতি এক সাথে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। তখন সে এক আশ্চর্য আলোকময় রাত। নবাব মোহাম্মদ আলি শাহ আরেকটি বিশাল বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন, নাম বারোদুয়ারী। বড় আকারের বারোটি দরজা থাকার কারণেই এর নাম বারোদুয়ারী। তবে সে নাম প্রচলিত নয়, এখন নাম হয়েছে পিকচার গ্যালারি। বড় ধরনের চিত্রশালা হিসেবে গড়ে উঠেছে। নবাবদের লাইফ সাইজ সব প্রতিকৃতি সযত্নে সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত এখানে। বারোদুয়ারী থেকে কিছু দূরেই ক্লক টাওয়ার, সুউচ্চ মিনারের মাথায় চারদিকে বিশাল চারটি ঘড়ি বসানো। ১৮৮৭ সালে নবাব নাসির-উদ-দীন হায়দরের নির্দেশ তৈরি এই ক্লক টাওয়ার চরিত্রের দিকে থেকে ব্রিটিশ স্থাপত্য। টাওয়ারের আয়তন কুড়ি বর্গফুট আর ২২১ ফুট উচ্চতায় উঠে একইসাথে চারদিকের মানুষকে সময় জানান দিচ্ছে বিগত সোয়া শ’ বছর ধরে। গান মেটালে তৈরি ঘড়িগুলোর যাবতীয় কিছু এসেছিল লন্ডন থেকে।
হম্ হ্যায় ফিদায়ে লখ্-নউ’।
ঠিক ভোর ছটায় হোটেলের সামনে পৌছে গেলাম। Payment @hotel এই শর্তে Fabhotel app এর মাধ্যমে বুকিং তাই বুকিং নিয়ে খুব একটা আশাবাদী ছিলাম না তবে হোটেলে পৌঁছে দেখলাম বুকিংটা করে খুব একটা ভুল করিনি।
একটু রেস্ট নিয়ে হোটেল থেকে বেরতেই কে যেন কানে কানে ফিসফাস করে বলে উঠলো - 'আপ লাখনাওমে আ গয়ে হ্যায় জনাব, যারা তসরিফ রাখিয়ে'।সত্যিই তো তুমি লক্ষ্মৌ বললে আর আমি শুনলাম বাইজীর ঘুঙরুর ছমছম... ঠমক ছমক... তুন্ডে-গলৌটি-বোটি কাবাবের সঙ্গে বিরিয়ানীর যুগলবন্দী...রুহ খস আর গুল-এর খুশবুতে মাতোয়ারা দিল... গলিতে গলিতে কালো চোখের গভীর চাহনিতে মাতাল করা সেই সুর ‘চলতে চলতে/ ইঁয়ুহি কোয়ি মিল গয়া থা/ সার-এ-রাহ্ চলতে চলতে’... শুধু লক্ষ্মৌ নিয়ে লিখতে গেলেই রাত কাবার হয়ে যাবে।তেহজিব আর তমিজ শব্দদুটির বা বাংলায় যাকে বলে শিষ্টাচার আর বিনয়ের এক অসাধারণ যুগলবন্দির নমুনা মেলে এই ঐতিহাসিক শহরটিতে।
লক্ষ্মৌর রাস্তায় বেরোলেই আমার কেমন জানি খিদে খিদে পায়। তার ওপর সারারাত গাড়ি চালানোর ধকল তাই এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা 'দস্তরখান'(খ্বান মানে থালা বা ট্রে। পহ্লবী শব্দ। এরথেকে দস্তরখ্বান বা দস্তরখান।) এর সামনে গাড়ি পার্ক করলাম।ওখানে উলটে তাওয়া কি পরোটা আর গলৌটি কাবাব খেতে খেতে মেয়ের সামনে ইতিহাসের প্যান্ডোরা খুলে বসলাম।১৭৩২ সালে সাদাত আলি খাঁ অওধের তখতে নবাব হয়ে বসেন। তাঁরই বংশের সবচেয়ে উজ্জ্বল কীর্তির মানুষ নবাব আসাফ-উদ-দৌল্লা ১৭৭৫ সালে ফৈজাবাদ থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে আসেন এই শহরে।
এই ঐতিহাসিক শহরটার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে নবাব আসফ-উদ-দৌলার নাম। যদিও নগরীর উত্পত্তি ও নামকরণ নিয়ে বিতর্ক কখনই লক্ষৌ-এর পিছু ছাড়েনি।
লক্ষৌ-এর নামকরণের পৌরাণিক কাহিনী কী বলে? রামায়ণে উল্লেখ রয়েছে, রামচন্দ্রের বনবাসের পর তিনি লক্ষ্মণের হাতে তুলে দিয়েছিলেন এই অঞ্চল। রামানুজ লক্ষ্মণের নাম অনুসারে এর নাম হলো লক্ষ্মনাবতী। এবং ক্রমে অপভ্রংশ হয়ে লক্ষৌতে রূপান্তরিত হলো। আর ভিন্ন একটি মত বলছে: জৌনপুরের মুসলিম শাসক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই নগরী। তার নির্দেশে হিন্দু স্থপতি লখনা নির্মাণ করেন একে। সেই স্থপতি লখনার নামই পরিবর্তিত রূপ নিয়ে লক্ষৌ হয়ে বেঁচে আছে নগরীর জৌলুসময় আবেদনের মধ্যে। যদিও নামের এই ঐতিহাসিক বিতর্কের কোনটিই চূড়ান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পায়নি।
১৭৮৪তে সারা উত্তর ভারত যখন দুর্ভিক্ষে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, চারিদিকে উঠছে মানুষের হাহাকার, নবাব আসাফ-উদ-দৌল্লা তাঁর রাজ্যের আর্ত মানুষদের সাহায্য করার জন্য শুরু করেন এক বিশাল নির্মাণ।
নবাব আসাফুদ্দৌল্লার ইচ্ছা ছিল বড় ইমামবাড়ার স্থাপত্য যেন তৎকালীন হিন্দুস্থানের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হয়। তিনি আজিব-এ-ঘারিব ...বিস্ময়কর ইমারত নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। বড় ইমামবাড়া নির্মাণ করার জন্য তৎকালীন হিন্দুস্থানের সমস্ত তাবড় তাবড় স্থপতিদের আউধের দরবারে ডাকা হয়েছিল। নবাবের কাছে দেশের সব স্থপতিদের পেশ করা নকশার মধ্যে কিফায়াতুল্লাহর পেশ করা নকশাটি বাদশাহের সেরা মনে হয়েছিল এবং তিনি নকশাটিকে বড় ইমামবাড়ার জন্য নির্বাচিত করেছিলেন। কিন্তু আকারে ও আয়তনে এত বড় স্থাপত্যের জন্য জমি নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে বহু খোঁজাখুজির পাওয়া গেল একটি জমি, কিন্তু তাতেও সমস্যা দেখা দিল। জমিতে রয়েছে একটি পর্ণকুটির এবং সেখানে বাস করেন এক বৃদ্ধা নাম... লাডো-সাকুম।
ইমামবাড়া নির্মাণ করতে হলে ওই কুটিরটিকেই সরাতে হয়। নবাব চাইলেই ওই জমি জোর করে কেড়ে নিতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করলেন না। তিনি লোক পাঠালেন বৃদ্ধার কাছে ... বৃদ্ধা যা চাইবেন নবাব তাই দিতে রাজি, শুধু জমিটি ছেড়ে দিতে হবে। বৃদ্ধা লাডো-সাকুম জানালেন তিনি এই স্থানে হাসান-হোসেনের তাজিয়া প্রতিষ্ঠা করেছেন সুতরাং তিনি এই স্থান ছাড়তে পারবেন না। খবর পৌঁছালো নবাবের কাছে। নবাব আসাফুদ্দৌল্লা প্রতিশ্রুতি দিলেন, বৃদ্ধা লাডো-সাকুম যেখানে তাজিয়া প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেখানেই তাজিয়া প্রতিষ্ঠিত করা হবে এবং একই দিনে তা কারবালায় নিয়ে যাওয়া হবে। বৃদ্ধা রাজী হলেন জমি ছেড়ে দিতে। নবাব তাকে ইনাম দিতে চাইলে বৃদ্ধা তা প্রত্যাখান করেন। তিনি নবাবের লোককে জানিয়ে দেন... একটি মহৎ কাজের জন্য তিনি জমি দান করেছেন, তার ইনাম লাগবে না।
নবাব কথা রেখেছিলেন... বড় ইমামবাড়ায় একটি মাত্র কাঠের দরজা যুক্ত একটি কক্ষ আছে যেখানে ওই বৃদ্ধার প্রতিষ্টিত তাজিয়াটি রাখা আছে এবং এখনও মহররমের দিন বড় ইমামবাড়া থেকে প্রথমে বৃদ্ধার তাজিয়া বেড়োয় তারপর মূল তাজিয়ার শোভাযাত্রা শুরু হয়।
বড় ইমামবাড়ার নির্মাণ শেষ হয়ে গেলে, উদ্বোধনের দিন নবাব কিফায়াতুল্লাহর কাছে জানতে চেয়েছিলেন...
তুমি কি ইনাম চাও?
জবাবে কিফায়াতুল্লাহ নাকি উত্তর দিয়েছিলেন...
-নবাব, হুজুর, আল্লাহ মালিক, হামকো দো-গজ জমিন চাহিয়ে ..
খুশি হয়েছিলেন নবাব এখনও বড় ইমামবাড়ায় শায়িত আছে তার দেহ। নির্মাণ করা হয়েছে তার জন্য নির্দিষ্ট কবর।শোনা যায়, এই নির্মানকার্যে দিনের বেলায় খাদ্যের বিনিময়ে গরীব মানুষেরা এসে কাজ করতেন আর রাতে তাঁদের সঙ্গেই মিশে যেতেন শহরের অভিজাতরা, যাঁদেরও সংসার সমানভাবেই ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়েছিল। দিনরাত কাজ হত। প্রতিদিন প্রায় কুড়ি হাজার মানুষ নাকি এই নির্মাণে হাত লাগিয়েছিলেন। এইভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল ‘আসাফি ইমামবাড়া’ বা 'বড়া ইমামবাড়া'। এই অসাধারণ উদ্যোগটি নবাবকে তুমুল জনপ্রিয় করেছিল তাঁর প্রজাদের কাছে আর চালু হয়েছিল একটি কথা, ‘যিসকো ন দে মওলা/ উসকো দে আসাফ-উদ-দৌল্লা’।
এক কোটি টাকা খরচ করে ১৭৯২ সালে শেষ হয় এই ইমামবাড়া তৈরির কাজ। ইমামবাড়ার কেন্দ্রীয় অংশটি ১৬৩ ফুট দীর্ঘ আর ৫৩ ফুট চওড়া। ৫০ ফুট উচ্চতার ভরহীন ছাদটি হল এই ইমামবাড়ার এমন এক বৈশিষ্ট্য, যা দেখে আজও তাক লেগে যায়। পুরো হলটির মাঝখানে কোন স্তম্ভ নেই, ছাদ ধরে রাখার জন্য।এই প্রাসাদেরই নিচতলায় দরবার ঘরে সমাধিস্থ রয়েছেন নবাব আসফ-উদ-দৌলা ও তাঁর প্রিয়তমা পত্নী। এ কারণে বড় ইমামবাড়ার মূল চত্বরে ঢোকার আগে জুতা খুলে রেখে যেতে হয়। তবে এই ইমামাবাড়ার আসল চমক কিন্তু ইমামবাড়ার ওপরের তলায়।
একদম ওপর তলায়, “এদিক ওদিক এঁকেবেঁকে সুড়ঙ্গ চলে গেছে"। সেগুলো এমন কায়দায় তৈরি যে, যতবারই এক একটা মোড় ঘুরছি, ততবারই মনে হচ্ছে যেন যেখানে ছিলাম সেখানেই আবার ফিরে এলাম। একটা গলির সঙ্গে আরেকটা গলির কোন তফাৎ নেই - দুদিকে দেয়াল, মাথার ওপর নিচু ছাত, আর দেওয়ালের মাঝখানটায় একটা করে খুপ্রি। গাইড বলল, নবাব যখন বেগমদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতেন, তখন ঐ খুপরিগুলোতে পিদিম জ্বলত। রাত্তিরবেলা যে কী ভূতুড়ে ব্যাপার হবে সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। গোলকধাঁধার শেষ গলিটার শেষে যে দরজা আছে, সেটা দিয়ে বেরোলেই ইমামবাড়ার বিরাট ছাতে গিয়ে পড়তে হয়। গিয়ে দেখি সেখান থেকে সমস্ত লখ্নৌ শহরটাকে দেখা যায়।ভুলভুলাইয়াতে ঘুরতে ঘুরতে বড়া ইমামাবাড়ার কেন্দ্রীয় হলের দোতলার ভেতরের বারান্দায় যখন উপস্থিত হবেন, গাইড চলে যাবে আপনার থেকে অন্তত ৫০ ফুট দূরে। তারপর এক মজা। দেওয়ালে মুখ লাগিয়ে কি যেন বলবেন গাইড। ৫০ ফুট দূরে থাকা আপনি যেই দেওয়ালে কান রাখবেন, শুনতে পাবেন গাইডের ফিসফিস করে বলা কথাগুলি। আজ্ঞে হ্যাঁ, এখানে দেওয়ালেরও কান আছে।এর দেয়াল তৈরি তে কয়লা র মিশ্রন ব্যাবহার করা হয়েছে , এতে করে প্রাসাদ এর যে কোন পাশে কিছু বললে, অন্য পাশে সেটা শুনতে পাওয়া যায়। আমাদের বর্ণনা কারি গাইড এর ভাষ্য অনুযায়ী , প্রাসাদ এর প্রহরীরা যাতে কোন ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে না পারে , তার জন্য এই নিরাপত্তা ...
বড়া ইমামাবাড়ার সামনেই রাস্তার ওপর রুমি দরওয়াজা। ইস্তানবুলের বিখ্যাত একটি দরওয়াজার অনুকরণে এটি তৈরি। চুনামাটির ফ্রিলের কাজ, গায়ে গুলদস্তা বা কুঁড়ি। একটু দূর থেকে দেখলে মনে হবে পদ্ম।
এখানেই দেখা হয়ে গেলো আমাদের গ্রুপের আর এক সদস্য অনিন্দ্যদার সাথে। উনিও তার পরিবারের সাথে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরেছিলেন।
এরপরের গন্তব্য ছোটা ইমামাবাড়া। ১৮৩৭ সালে নিজের স্মৃতিসৌধ হিসাবে এটি তৈরি করেন আদিল শাহ। প্রাসাদের ভেতরটা এখন খুবই শান্ত, একেবারে যাকে বলে পিনপতন নিস্তব্ধতা। অনিন্দ্য সুন্দর সব ঝাড়বাতি ও আরো নানা আলোর বাতি, গিল্টি করা আয়না আর দেওয়ালে চারুময় কারুকাজ দেখে যে কারো চক্ষুস্থির হয়ে যাবে। এই প্রাসাদের কয়েকটি গম্বুজের মধ্যে বড় গম্বুজটি সোনার, অন্তত ওতে সোনার কারুকাজ রয়েছে এমন জনপ্রিয় বহুলশ্রুত জনশ্রুতি রয়েছে। মহরম উৎসবের সময় প্রাসাদের সব ঝাড় লক্তন আর আলোর বাতি এক সাথে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। তখন সে এক আশ্চর্য আলোকময় রাত। নবাব মোহাম্মদ আলি শাহ আরেকটি বিশাল বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন, নাম বারোদুয়ারী। বড় আকারের বারোটি দরজা থাকার কারণেই এর নাম বারোদুয়ারী। তবে সে নাম প্রচলিত নয়, এখন নাম হয়েছে পিকচার গ্যালারি। বড় ধরনের চিত্রশালা হিসেবে গড়ে উঠেছে। নবাবদের লাইফ সাইজ সব প্রতিকৃতি সযত্নে সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত এখানে। বারোদুয়ারী থেকে কিছু দূরেই ক্লক টাওয়ার, সুউচ্চ মিনারের মাথায় চারদিকে বিশাল চারটি ঘড়ি বসানো। ১৮৮৭ সালে নবাব নাসির-উদ-দীন হায়দরের নির্দেশ তৈরি এই ক্লক টাওয়ার চরিত্রের দিকে থেকে ব্রিটিশ স্থাপত্য। টাওয়ারের আয়তন কুড়ি বর্গফুট আর ২২১ ফুট উচ্চতায় উঠে একইসাথে চারদিকের মানুষকে সময় জানান দিচ্ছে বিগত সোয়া শ’ বছর ধরে। গান মেটালে তৈরি ঘড়িগুলোর যাবতীয় কিছু এসেছিল লন্ডন থেকে।
নবাবী লক্ষ্ণৌ-এর শেষ আভিজাত্য ছিল কায়সারবাগ। চারটি প্রবেশ পথের দেওয়াল ঘেরা এই বাগে কি ছিল না! গোলকুণ্ডা দুর্গ থেকে পার্থেননের করিন্থিয়ান স্তম্ভ। আর ছিল বিভিন্ন পরাবাস্তব নির্মাণ। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল কায়সারবাগের প্রায় অনেকটাই। বাদবাকি বেশ কিছু হারিয়েছে কালের কবলে।
লক্ষ্মৌয়ের আরেক বিখ্যাত স্থাপত্য রেসিডেন্সি।এরও নির্মাতা বা মূল প্রতিষ্ঠাতা নবাব আসফ-উদ-দৌলা। ১৭৭৫ সালে ব্রিটিশ রাজ প্রতিনিধি ও পর্যটকদের বিশ্রামাগার হিসেবে এই রেসিডেন্সি কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। তবে শেষ হয়েছিল ১৮০০ সালে নবাব সাদাৎ আলি খানের আমলে। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের ১৮৫৭-র ৩১শে মে, লক্ষ্ণৌ-এর আমজনতা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ রেসিডেন্সি। আজও ভগ্ন রেসিডেন্সির মাটির তলার ঘরে সিপাহীদের কামানের লোহার গোলা পড়ে আছে। এখানেই থরথর করে কাঁপতে থাকা ব্রিটিশ সিংহদের ৫৮ দিন ধরে অবরোধ করে রেখেছিল জনতা আর সিপাহীরা। শেষ পর্যন্ত বাইরে থেকে অসংখ্য ব্রিটিশ সেনা নিয়ে এসে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল লক্ষ্ণৌকে। ধ্বংস হয়েছিল একের পর এক সৌধ। গোমতীর জলে ভেসে গিয়েছিল ভারতীয় লাশেরা। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল নবাবী লক্ষ্ণৌ। এখনো প্রতি সন্ধ্যায় আলোক সাজে রেসিডেন্সি হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর সুন্দর।
যাক অনেক ঘোরাঘুরি হল, খিদে তো পেয়েছে জব্বর।এখানে কাবাব খেতে যেতে হবে আমিনাবাদে, হজরতগঞ্জে অথবা আকবরী গেটের কাছে চওকে। ‘উল্টে তাওয়া কি পরোটা’ দিয়ে গলৌটি কাবাব। শাখাওয়াত-এ খান জিভে জল আনা শাম্মী কাবাব। গুমতি নগরের দস্তরখান-এ খান বোটি কাবাব।
বিরিয়ানীর জন্য ইদ্রিস অথবা দস্তরখান। লস্যিটাই বা বাদ থাকে কেনো? চওকের শ্রী কর্ণারে অথবা আমিনাবাদে পন্ডিত রাজা কি ঠাণ্ডাই লস্যির জন্য বিখ্যাত।এছাড়া আছে প্রকাশ এর কুলপি, হজরতগঞ্জের মালহোত্রা অথবা আকবরী দরওয়াজার আজহার পান ভাণ্ডার । এর মধ্যে দুএকটা জায়গায় ঢুঁ মারতে গিয়ে কখন যে সন্ধ্যেটা রাতের গিয়ে গড়িয়ে পড়ল খেয়াল করতে পারিনি।
লক্ষ্ণৌর ইতিহাসটা যখন ছুঁলামই তখন একজনের নাম না করলে লেখাটা অসম্পুর্ন থেকে যায়।আসাফ-উদ-দৌল্লা যে রূপকথার সৃষ্টি করে গেছিলেন, তার সঠিক উত্তরসুরী ছিলেন ওয়াজেদ আলি শাহ। নবাবী আমলের লক্ষ্ণৌ সম্পর্কে সেরা বই আব্দুল হলীম শবর-এর ‘গুযিশতা লক্ষ্ণৌ’। শবর লিখেছেন, যেহেতু ওয়াজেদ আলি শাহ গাম্ভীর্যপূর্ণ মানুষদের কাছে পরিচিত ছিলেন ফুর্তিবাজ বলে আর যেহেতু তাঁর সময়েই নবাবী লক্ষ্ণৌ-এর ইতিহাসের শেষ পৃষ্ঠাগুলি লেখা হয়েছে, তাই তিনি সবাইকার ধিক্কার আর বিদ্রুপের পাত্র। অথচ ব্রিটিশ-প্রতাপে একই সময়ে ভেঙে পড়ছে হিন্দুস্তানের তাবৎ দেশীয় শক্তি। পাঞ্জাবে শিখ, দক্ষিণে মারাঠা, দিল্লীতে মুঘলশাহী, বাংলায় নবাব নাজিম, সবাই গুঁড়িয়ে যাচ্ছেন ব্রিটিশ গোলার ধাক্কায়। তাহলে কেন শুধু ওয়াজেদ-ই ধিক্কৃত হবেন?
১৮৫৪-র ১৩ই মার্চ, ফাল্গুনের সকাল। হালকা কুয়াশার আস্তরনে গোমতী নদীর মায়াবী বিচ্চুরন। প্রাসাদের ছাদে একলা পায়চারী করছেন ওয়াজেদ আলি শাহ। আজ যাত্রা সুদূর বাংলায়। ব্রিটিশ রেসিডেন্ট-এর নির্দেশে অওধের নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে আজ তাঁর প্রাণপ্রিয় লক্ষ্ণৌ ছেড়ে চলে যেতে হবে। চলে যেতে হবে কলকাতার তিন কিলোমিটার দক্ষিণে মেটিয়াব্রুজে – চিরনির্বাসনে।
যাক অনেক ঘোরাঘুরি হল, খিদে তো পেয়েছে জব্বর।এখানে কাবাব খেতে যেতে হবে আমিনাবাদে, হজরতগঞ্জে অথবা আকবরী গেটের কাছে চওকে। ‘উল্টে তাওয়া কি পরোটা’ দিয়ে গলৌটি কাবাব। শাখাওয়াত-এ খান জিভে জল আনা শাম্মী কাবাব। গুমতি নগরের দস্তরখান-এ খান বোটি কাবাব।
বিরিয়ানীর জন্য ইদ্রিস অথবা দস্তরখান। লস্যিটাই বা বাদ থাকে কেনো? চওকের শ্রী কর্ণারে অথবা আমিনাবাদে পন্ডিত রাজা কি ঠাণ্ডাই লস্যির জন্য বিখ্যাত।এছাড়া আছে প্রকাশ এর কুলপি, হজরতগঞ্জের মালহোত্রা অথবা আকবরী দরওয়াজার আজহার পান ভাণ্ডার । এর মধ্যে দুএকটা জায়গায় ঢুঁ মারতে গিয়ে কখন যে সন্ধ্যেটা রাতের গিয়ে গড়িয়ে পড়ল খেয়াল করতে পারিনি।
লক্ষ্ণৌর ইতিহাসটা যখন ছুঁলামই তখন একজনের নাম না করলে লেখাটা অসম্পুর্ন থেকে যায়।আসাফ-উদ-দৌল্লা যে রূপকথার সৃষ্টি করে গেছিলেন, তার সঠিক উত্তরসুরী ছিলেন ওয়াজেদ আলি শাহ। নবাবী আমলের লক্ষ্ণৌ সম্পর্কে সেরা বই আব্দুল হলীম শবর-এর ‘গুযিশতা লক্ষ্ণৌ’। শবর লিখেছেন, যেহেতু ওয়াজেদ আলি শাহ গাম্ভীর্যপূর্ণ মানুষদের কাছে পরিচিত ছিলেন ফুর্তিবাজ বলে আর যেহেতু তাঁর সময়েই নবাবী লক্ষ্ণৌ-এর ইতিহাসের শেষ পৃষ্ঠাগুলি লেখা হয়েছে, তাই তিনি সবাইকার ধিক্কার আর বিদ্রুপের পাত্র। অথচ ব্রিটিশ-প্রতাপে একই সময়ে ভেঙে পড়ছে হিন্দুস্তানের তাবৎ দেশীয় শক্তি। পাঞ্জাবে শিখ, দক্ষিণে মারাঠা, দিল্লীতে মুঘলশাহী, বাংলায় নবাব নাজিম, সবাই গুঁড়িয়ে যাচ্ছেন ব্রিটিশ গোলার ধাক্কায়। তাহলে কেন শুধু ওয়াজেদ-ই ধিক্কৃত হবেন?
১৮৫৪-র ১৩ই মার্চ, ফাল্গুনের সকাল। হালকা কুয়াশার আস্তরনে গোমতী নদীর মায়াবী বিচ্চুরন। প্রাসাদের ছাদে একলা পায়চারী করছেন ওয়াজেদ আলি শাহ। আজ যাত্রা সুদূর বাংলায়। ব্রিটিশ রেসিডেন্ট-এর নির্দেশে অওধের নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে আজ তাঁর প্রাণপ্রিয় লক্ষ্ণৌ ছেড়ে চলে যেতে হবে। চলে যেতে হবে কলকাতার তিন কিলোমিটার দক্ষিণে মেটিয়াব্রুজে – চিরনির্বাসনে।
যাত্রা যখন শুরু হয় নবাবের, সারা লক্ষ্ণৌ শোকে পাথর। কি গরীব কি ধনী, কি যুবা কি বয়স্ক সকলেই চোখের জলে বিদায় জানান তাঁদের প্রিয় নবাবকে। তাঁর প্রাণপ্রিয় লক্ষ্ণৌ ছেড়ে চলে যাবার বেদনায় তাঁর ব্যাথাতুর হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়-
‘বাবুল মোরা, নইহার ছুটো হি যায়ে
চার কাহার মিলি, মোরি ডোলিয়া সাজায়ে...’
চার কাহার মিলি, মোরি ডোলিয়া সাজায়ে...’
**মুখ্যদ্বারে পদার্পন****#হরিদ্বার_পর্ব
কোই খায় হালুয়া পুরী বরফি মিলাকে,
সাধু খায় সুকড়া টুকড়া চিমটা বজাইকে।
কোই যায় হাতি ঘোড়া পালকি সাজাইকে,
সাধু যায় পাঁও পাঁও চিমটা বজাইকে'।
সাধু খায় সুকড়া টুকড়া চিমটা বজাইকে।
কোই যায় হাতি ঘোড়া পালকি সাজাইকে,
সাধু যায় পাঁও পাঁও চিমটা বজাইকে'।
সকাল ছটায় স্নান করে ফ্রেশ হয়ে আবার যখন গাড়ি স্টার্ট দিলাম তখন আগের দিনের সব ক্লান্তি ধুয়ে মুছে সাফ। বিগত বছরগুলোতে বেশ কয়েকবার হরিদ্দারের ওপর দিয়ে গেলেও গঙ্গাআরতিটা প্রতিবারই মিস হয়ে গেছিলো। তাই এবার প্রথম থেকেই ঠিক ছিল গঙ্গাআরতির আগেই হরিদ্দার ঢুকবো। আজকে আমাদের রুট Hardoi - Sahajanpur - Bareilly bypass - Moradabad - Dhampur - Nagina - Najibabad - Eastern ganga Canal road.রাস্তার কন্ডিশান নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই।নতুন কংক্রীটের রাস্তা,প্রচুর পেট্রোল পাম্প, ট্রাফিক বেশ কম। খাওয়ার হোটেল খুব একটা চোখে না পড়লেও আমাদের গাড়িতে শুকনো খাবারের অফুরন্ত স্টক থাকায় খুব একটা অসুবিধা হয়নি। নাজিদাবাদে ঢোকার মুখে একটু ট্রাক ট্রাফিকের জট ছাড়া পুরো জার্নিটাই ছিলো নির্ঝঞ্ঝাট।
যারা আজ থেকে বছর বিশেক আগেও হরিদ্বার গেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন জায়গাটার নাম লেখা থাকত হরদ্বার, লোকে বলতোও হরদোয়ার। হর অর্থাৎ শিব; পঞ্চকেদারে যাওয়ার রাস্তা এখান থেকেই শুরু, তাই হর-দ্বার, আমরা বাঙালিরা ভুল করে হরিদ্বার বলি। ২০১৫ র পরপর এসে দেখি সব হরিদ্বার (হরি=বিষ্ণু) হয়ে গেছে। শৈবপ্রধান সংস্কৃতির বিষ্ণুপ্রধান সংস্কৃতিতে রূপান্তর? আসলে এখানে দুটো নামই চালু ছিল – বিষ্ণুর উপাসকরা হরিদ্বার, শৈবরা হরদ্বার, স্থানীয়দের মধ্যে হরদ্বারই চালু ছিল। হর কি পৌড়ী, মূল গঙ্গার ওপারে কনখল, যেখানে দক্ষের মহাযজ্ঞ, সতীর দেহত্যাগ, শিবের তাণ্ডবনৃত্যের শুরু, পঞ্চকেদার সব মিলিয়ে শিবই প্রধান ছিলেন। শক্তি ছাড়া শিব হয় না, অন্তত শৈবরা তাই বলেন। হরিদ্বারে তিনটি শক্তিমন্দির আছে, চণ্ডী, মনসা, মায়া। এই মায়া সতীর একটি পীঠ, এতটাই প্রসিদ্ধ ছিল যে, ‘মায়াপুরী’ ছিল প্রাচীন হরদ্বার বা হরিদ্বারের নাম।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ হোটেলে পৌঁছেই। Goibibo app এর মাধ্যমে হোটেলটা আগে থেকেই বুকিং ছিল তাই হোটেল খোঁজার ঝক্কিটা পোহাতে হয়নি। মালপত্র রেখে চলে এলাম গঙ্গার ধারে হর কি পৌরিতে।গঙ্গা বয়ে চলেছে আপন মনে । বেড়েছে জনস্রোত, দোকানপাট আর ট্যুরিষ্ট । কিন্তু গঙ্গার জলে পা ডুবিয়েই মনে হল হরিদ্বার অমলিন । এখানে সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলছে । কত জল বয়ে গেছে সুদূর হিমালয়ের বরফ গলে গঙ্গার ওপর দিয়ে কিন্তু গঙ্গা পড়ে আছে গঙ্গাতেই । আজন্মকাল ধরে মানুষের পাপ ধুতে ধুতে এখনো ক্লান্ত হয়নি সে ।
এখান থেকেই গঙ্গার সমতলে যাত্রা শুরু হয়েছে।পবিত্র হিন্দুতীর্থ হরি ও হরের সহাবস্থান ঘটেছে হরিদ্বারে। গঙ্গাই হরিদ্বারের মূল আকর্ষণ। পাহাড় থেকে গঙ্গা নামছে সমতলে, হরিদ্বারের ‘হরি কি পাউরি’ ঘাটে।
হর কি পৌড়ির অর্থ হল শিবের সিঁড়ি। সমুদ্রমন্থনের পর গড়ুর পাখী যখন কলসে করে অমৃত নিয়ে উড়ে চলেছিলেন আকাশে তখন হরিদ্বারের গঙ্গার মধ্যে সেই অমৃতের ফোঁটা নিক্ষিপ্ত হয় এবং এই স্থানকে তাই ব্রক্ষকুন্ড বলা হয় । বৈদিকযুগে নাকি ভগবান বিষ্ণু এবং মহেশ্বর এই ব্রহ্মকুন্ড দর্শন করতে এসেছিলেন ।
প্রতিদিন সূর্যাস্তে এবং সূর্যোদয়ের পূর্ব মূহুর্ত্তে গঙ্গার পাড়ে এই হর কি পৌরীতে দাঁড়িয়ে পুরোহিতেরা বিশালাকার প্রদীপ নিয়ে এক অপূর্ব আরতি করেন । শ্বেতবস্ত্র পরিহিত পুরোহিতদের উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘দেবী সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে’। সাথে নিয়মমাফিক সচেতনবাণীও, গঙ্গাকে দূষিত না করার আবেদন। তারপর ১০০৮ দীপসম্বলিত পঞ্চপ্রদীপে গঙ্গা আরতি। মোট বারোজন পুরোহিত আরতিতে থাকেন, সাথে বাজনা ইত্যাদি। প্রদীপের অনির্বান শিখার প্রতিবিম্ব পড়ে গঙ্গায়, প্রচুর ভক্তের সমাগমে, সুললিত মন্ত্রোচ্চারণে , বিশাল ঘন্টাধ্বনিতে, শঙ্খে শঙ্খে অণুরনিত হয় গঙ্গার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ।সে এক অনির্বচনীয় ঘটনা। ঘাটগুলো সুন্দর করে বাঁধানো। অনেকটা চওড়া, বহু লোকে স্নান করতে পারে।স্বচ্ছ ভারত মিশনে এখানে অনেকগুলো শৌচালয়, কাপড় বদলানোর জায়গা হয়েছে। ঘাটের ওপর অনেকগুলো ব্রিজএখানে মূল গঙ্গার মাঝে চড়া পড়ে গেছে, সেই চড়াটিকে বাঁধিয়ে সুন্দর বসার জায়গা হয়েছে। চড়া থেকে সুন্দর আরতি দেখা যায়।
পুরাতন আর নতুন মিলিয়ে হাজারের বেশি মন্দির রয়েছে হরিদ্বারে। অন্যসব ধর্মীয় শহরগুলির মতো হরিদ্বারের মুল অংশটা বেশ ঘিঞ্জি। দুটো পাহাড়ের মাঝখানে হরিদ্বার শহর, পুবে চন্ডী এবং পশ্চিমে মনসা দুই দেবীর নামে দুই পাহাড়। মনসা দেবী আমাদের বাংলার লৌকিক দেবী হয়েও এই বিদেশ বিভূঁইয়ে ভদ্রমহিলা কি করছেন সেটা আমার বেশ কৌতুহলের উদ্রেক করলো। কিন্তু পেটে ছুঁচোর ডন আর দাদা বৌদির হোটেলের নিরামিষ থালির সুখস্মৃতি আমার পেটুক স্বত্তাটি আমার অনুসন্ধিৎসু স্বত্তার ওপর ভেটো দিয়ে দিলো। হরিদ্বারে গলিতে গলিতে দাদাবৌদির হোটেল । তবে ভোলাগিরি আশ্রম ধর্মশালার বিপরীতে, বিষ্ণুঘাটেরটা নাকি আসল । ১২০/- ভেজ মিল । পেটপুরে যতখুশি খাওয়াদাওয়া । মেনুতে ছিলো ভাত (বা রুটি) , ডাল, ঘি, বেগুনী, স্যালাড, পটলের তরকারি, বাঁধাকপির তরকারী, পাঁপড়, তেঁতুলের চাটনী আর টক দই। তারপর বেড়িয়ে মাটির ভাঁড়ে একগ্লাস গরম দুধ আর একবাটি রাবড়ি।না না সেসব ছবি দিয়ে আর আপনাদের ওপর টর্চার বাড়াবো না। তবে ওই ভীমের খাবার খেয়ে হোটেলে ঢুকে যে কুম্ভকর্ণ এর মত নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছি তা নিয়ে আপনারা কোনো দ্বিমত পোষন করবেন না।
যারা আজ থেকে বছর বিশেক আগেও হরিদ্বার গেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন জায়গাটার নাম লেখা থাকত হরদ্বার, লোকে বলতোও হরদোয়ার। হর অর্থাৎ শিব; পঞ্চকেদারে যাওয়ার রাস্তা এখান থেকেই শুরু, তাই হর-দ্বার, আমরা বাঙালিরা ভুল করে হরিদ্বার বলি। ২০১৫ র পরপর এসে দেখি সব হরিদ্বার (হরি=বিষ্ণু) হয়ে গেছে। শৈবপ্রধান সংস্কৃতির বিষ্ণুপ্রধান সংস্কৃতিতে রূপান্তর? আসলে এখানে দুটো নামই চালু ছিল – বিষ্ণুর উপাসকরা হরিদ্বার, শৈবরা হরদ্বার, স্থানীয়দের মধ্যে হরদ্বারই চালু ছিল। হর কি পৌড়ী, মূল গঙ্গার ওপারে কনখল, যেখানে দক্ষের মহাযজ্ঞ, সতীর দেহত্যাগ, শিবের তাণ্ডবনৃত্যের শুরু, পঞ্চকেদার সব মিলিয়ে শিবই প্রধান ছিলেন। শক্তি ছাড়া শিব হয় না, অন্তত শৈবরা তাই বলেন। হরিদ্বারে তিনটি শক্তিমন্দির আছে, চণ্ডী, মনসা, মায়া। এই মায়া সতীর একটি পীঠ, এতটাই প্রসিদ্ধ ছিল যে, ‘মায়াপুরী’ ছিল প্রাচীন হরদ্বার বা হরিদ্বারের নাম।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ হোটেলে পৌঁছেই। Goibibo app এর মাধ্যমে হোটেলটা আগে থেকেই বুকিং ছিল তাই হোটেল খোঁজার ঝক্কিটা পোহাতে হয়নি। মালপত্র রেখে চলে এলাম গঙ্গার ধারে হর কি পৌরিতে।গঙ্গা বয়ে চলেছে আপন মনে । বেড়েছে জনস্রোত, দোকানপাট আর ট্যুরিষ্ট । কিন্তু গঙ্গার জলে পা ডুবিয়েই মনে হল হরিদ্বার অমলিন । এখানে সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলছে । কত জল বয়ে গেছে সুদূর হিমালয়ের বরফ গলে গঙ্গার ওপর দিয়ে কিন্তু গঙ্গা পড়ে আছে গঙ্গাতেই । আজন্মকাল ধরে মানুষের পাপ ধুতে ধুতে এখনো ক্লান্ত হয়নি সে ।
এখান থেকেই গঙ্গার সমতলে যাত্রা শুরু হয়েছে।পবিত্র হিন্দুতীর্থ হরি ও হরের সহাবস্থান ঘটেছে হরিদ্বারে। গঙ্গাই হরিদ্বারের মূল আকর্ষণ। পাহাড় থেকে গঙ্গা নামছে সমতলে, হরিদ্বারের ‘হরি কি পাউরি’ ঘাটে।
হর কি পৌড়ির অর্থ হল শিবের সিঁড়ি। সমুদ্রমন্থনের পর গড়ুর পাখী যখন কলসে করে অমৃত নিয়ে উড়ে চলেছিলেন আকাশে তখন হরিদ্বারের গঙ্গার মধ্যে সেই অমৃতের ফোঁটা নিক্ষিপ্ত হয় এবং এই স্থানকে তাই ব্রক্ষকুন্ড বলা হয় । বৈদিকযুগে নাকি ভগবান বিষ্ণু এবং মহেশ্বর এই ব্রহ্মকুন্ড দর্শন করতে এসেছিলেন ।
প্রতিদিন সূর্যাস্তে এবং সূর্যোদয়ের পূর্ব মূহুর্ত্তে গঙ্গার পাড়ে এই হর কি পৌরীতে দাঁড়িয়ে পুরোহিতেরা বিশালাকার প্রদীপ নিয়ে এক অপূর্ব আরতি করেন । শ্বেতবস্ত্র পরিহিত পুরোহিতদের উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘দেবী সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে’। সাথে নিয়মমাফিক সচেতনবাণীও, গঙ্গাকে দূষিত না করার আবেদন। তারপর ১০০৮ দীপসম্বলিত পঞ্চপ্রদীপে গঙ্গা আরতি। মোট বারোজন পুরোহিত আরতিতে থাকেন, সাথে বাজনা ইত্যাদি। প্রদীপের অনির্বান শিখার প্রতিবিম্ব পড়ে গঙ্গায়, প্রচুর ভক্তের সমাগমে, সুললিত মন্ত্রোচ্চারণে , বিশাল ঘন্টাধ্বনিতে, শঙ্খে শঙ্খে অণুরনিত হয় গঙ্গার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ।সে এক অনির্বচনীয় ঘটনা। ঘাটগুলো সুন্দর করে বাঁধানো। অনেকটা চওড়া, বহু লোকে স্নান করতে পারে।স্বচ্ছ ভারত মিশনে এখানে অনেকগুলো শৌচালয়, কাপড় বদলানোর জায়গা হয়েছে। ঘাটের ওপর অনেকগুলো ব্রিজএখানে মূল গঙ্গার মাঝে চড়া পড়ে গেছে, সেই চড়াটিকে বাঁধিয়ে সুন্দর বসার জায়গা হয়েছে। চড়া থেকে সুন্দর আরতি দেখা যায়।
পুরাতন আর নতুন মিলিয়ে হাজারের বেশি মন্দির রয়েছে হরিদ্বারে। অন্যসব ধর্মীয় শহরগুলির মতো হরিদ্বারের মুল অংশটা বেশ ঘিঞ্জি। দুটো পাহাড়ের মাঝখানে হরিদ্বার শহর, পুবে চন্ডী এবং পশ্চিমে মনসা দুই দেবীর নামে দুই পাহাড়। মনসা দেবী আমাদের বাংলার লৌকিক দেবী হয়েও এই বিদেশ বিভূঁইয়ে ভদ্রমহিলা কি করছেন সেটা আমার বেশ কৌতুহলের উদ্রেক করলো। কিন্তু পেটে ছুঁচোর ডন আর দাদা বৌদির হোটেলের নিরামিষ থালির সুখস্মৃতি আমার পেটুক স্বত্তাটি আমার অনুসন্ধিৎসু স্বত্তার ওপর ভেটো দিয়ে দিলো। হরিদ্বারে গলিতে গলিতে দাদাবৌদির হোটেল । তবে ভোলাগিরি আশ্রম ধর্মশালার বিপরীতে, বিষ্ণুঘাটেরটা নাকি আসল । ১২০/- ভেজ মিল । পেটপুরে যতখুশি খাওয়াদাওয়া । মেনুতে ছিলো ভাত (বা রুটি) , ডাল, ঘি, বেগুনী, স্যালাড, পটলের তরকারি, বাঁধাকপির তরকারী, পাঁপড়, তেঁতুলের চাটনী আর টক দই। তারপর বেড়িয়ে মাটির ভাঁড়ে একগ্লাস গরম দুধ আর একবাটি রাবড়ি।না না সেসব ছবি দিয়ে আর আপনাদের ওপর টর্চার বাড়াবো না। তবে ওই ভীমের খাবার খেয়ে হোটেলে ঢুকে যে কুম্ভকর্ণ এর মত নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছি তা নিয়ে আপনারা কোনো দ্বিমত পোষন করবেন না।
Well, my road might be rocky
The stones might cut my face
But as some folks ain’t got no road at all
They gotta stand in the same old place.
- বব ডিলন
The stones might cut my face
But as some folks ain’t got no road at all
They gotta stand in the same old place.
- বব ডিলন
আগের দিন রাতে ট্রিপের প্ল্যানের একটা বেশ বড়সড় রদবদল করে ফেলেছি। চারধামের প্ল্যানটা কেটেছেঁটে দুধামে ঠেকিয়েছি। তাই আজকের গন্তব্য কেদারনাথ। ভোর ভোর মনে মনে হরিদ্বারকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলাম। মনের মধ্যে একটা আলাদা উত্তেজনা। আজ থেকেই তো হিমালয়কে ছুঁয়ে চলার আসল অনুভূতির সুত্রপাত। সেই চেনা গঙ্গার পাড়, পাহাড়ি বাতাসে গাড়ি এগোতে থাকলো। কিন্তু কিছুটা এগোতেই ধুলোয় চারিদিক ঢাকা! চারধামে পৌছনোর রাস্তা দুই লেন থেকে চার লেন হওয়ার মহাযজ্ঞ চলছে, তাই সারা পাহাড় জুড়ে চলছে বিশাল কর্মকাণ্ড। কয়েকবছর আগেই প্রকৃতির রোষ গ্রাস করেছিল এই দেবভূমিকে, তবুও আমরা বোধহয় সেই একই ভুল করে চলেছি, ধর্ম কোথাও যেন পণ্য, রাজনীতির ঘুঁটি -কিন্তু প্রকৃতি তো রাজনীতি বোঝে না, সে কি সহ্য করবে তার উপর এই অত্যাচার? উত্তর সময়ের গর্ভে রেখে আমরা এগোতে থাকলাম আমাদের গন্তব্যের দিকে।
শুরুতেই হর কি পউড়ির পাশেই বিশাল শিবমূর্তি, বরাভয় মুদ্রায়। আমরা চলতি গাড়ি থেকেই মনে মনে প্রণাম জানিয়ে এগিয়ে চললাম। প্রথম গন্তব্য ঋষিকেশ, হরিদ্বার থেকে দূরত্ব কুড়ি কিলোমিটার। রাস্তার উপর সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে কেদারনাথ ২৫৩ কিলোমিটার। হরিদ্বার থেকে ঋষিকেশ পর্যন্ত রাস্তা সমতল দিয়েই চলেছে। ডানদিকে গঙ্গা কিছুটা দূর দিয়ে বয়ে চলেছে, বামদিকে মনসা পাহাড়ের সঙ্গী সাথীরা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে, ওদের একটা পোশাকি নাম আছে, মতিচুর রেঞ্জ। মতিচুর রেঞ্জ আসলে শিবালিক রেঞ্জেরই দক্ষিণভাগের একটা অংশ। আর আছে পথের দুদিকে গভীর অরণ্য, রাজাজী ন্যাশানাল পার্ক। এই অরণ্যের মধ্যে দিয়ে পাশাপাশি ছুটে চলেছে আমাদের রাস্তা আর হরিদ্বার থেকে দেরাদুনের রেলপথ। পথের ধারে ধারে সাইনবোর্ড ঝোলানো, ‘বুনোহাতির থেকে সাবধান’। এই জঙ্গলে নাকি প্রচুর হাতি আছে। তাই গাড়ি আর ট্রেন দুটোই চলে সতর্ক হয়ে ধীরে ধীরে।আধঘণ্টার মধ্যেই আমরা ঋষিকেশ। চন্দ্রভাগা নদীর ব্রীজ, মুনি কি রেতি পার হয়ে লছমন ঝোলাকে ডানহাতে রেখে আমরা এগিয়ে চললাম ব্যাসীর দিকে। ঋষিকেশ পেরিয়ে আমরা আস্তে আস্তে হিমালয়ের গভীরে ঢুকতে শুরু করলাম। ঋষিকেশ থেকে ব্যাসী ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা। এই ৩৫ কিলোমিটারের প্রায় পুরোটাই রাস্তার ধারে বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপনের হোডিং। অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের বিজ্ঞাপন। বর্তমানের ঋষিকেশ বিখ্যাত বিদেশী ‘ইয়োগী’ আর অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্য। বাঞ্জি জাম্পিং, ফ্লাইং ফক্স, রিভার র্যাফটিং, ফরেস্ট ক্যাম্পিং কী নেই সেই তালিকায়। এরই মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে গাড়ি সাইড করলাম। এখানে রাস্তা গঙ্গার কিনারা থেকে খুবই কাছে, বাঁদিকে হিমালয়ের প্রাচীর, ডানদিক দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গার সনাতনী ধারা। সেধারার কুলুকুলু শব্দ ছাড়া একটাও শব্দ নেই কোনদিকে। সামনে কিছটা আগে একটা তারের ঝোলা সেতু বেয়ে একটা পায়ে চলা পথ চলে গেছে গঙ্গার ওপারে কোন পাহাড়ি গ্রামে।
সকাল সাড়ে নটায় পৌছালাম ব্যাসী। দ্বাপর যুগে ব্যাসী ছিল মহাভারত রচয়িতা বেদব্যাসের তপোস্থলী। এই ঘোরকলিতেও ব্যাসীতে বেদব্যাস বর্তমান, একটি শ্বেতপাথরের ব্যাসমূর্তিরূপে। তার দুটি হাত জড়ো করা, সেখান থেকে নেমে আসছে শীতল জলধারা। বেদব্যাস বর্তমানে তীর্থযাত্রীদের হাতে জল দিয়ে থাকেন।
ব্যাসী ছাড়িয়ে আমরা চললাম দেবপ্রয়াগের পথে। আঁকাবাঁকা পথ, ধীরে ধীরে চড়াইয়ের পথে উঠে চলেছে। রাস্তার প্রতিটি বাঁকে অপেক্ষা করে রয়েছে বিস্ময়। একদিকে মাথা উঁচু করে রয়েছে হিমালয়ের অভ্রভেদী চূড়া, ডানদিকে অতল খাদ, তার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা। এখানে হিমালয় সবুজে সবুজ। পাহাড়ের গায়ে নিরাবরণ পাথরের স্তর নেই বললেই চলে। গাছপাতার ফাঁক দিয়ে রোদের রশ্মি এসে পড়েছে পিচঢালা মসৃণ পথের উপর। ব্যাসী থেকে দেবপ্রয়াগ ৩৯ কিলোমিটার। বেলা সাড়ে দশটায় রাস্তার একপাশে গাড়ি থামিয়ে দাড়িয়ে পরলাম।গাড়ি থেকে নেমে ডানদিকে তাকাতেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম দেবপ্রয়াগের অপার সৌন্দর্যে। বাঁদিক থেকে ভাগীরথী, ডানদিক থেকে অলকানন্দা এসে মিলেছে দেবপ্রয়াগ সঙ্গমে। মাঝখানে ত্রিভুজাকার পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট শহর দেবপ্রয়াগ। ত্রিভুজাকার পাহাড়টা সবুজে সবুজ। তার পিছনে দেখা যাচ্ছে দূরের দূরের নীল রঙের সব পাহাড়চূড়া, একটার পর একটা। ভাগীরথীর জল খানিক ঘোলা, অলকানন্দার জল সবুজাভ।
সঙ্গমে দুই নদীর জলের বিভেদ স্পষ্ট। এই সঙ্গমেই উৎপত্তি পতিতপাবনী গঙ্গার। (গঙ্গোত্রী থেকে ভাগিরথীর উৎপত্তি, দেবপ্রয়াগে ভাগীরথীর সঙ্গে অলকানন্দা ও মন্দাকিনীর মিলিত ধারা একত্রে অলকানন্দা নামে মিশে গঙ্গার সৃষ্টি করেছে)। চারজনে মুগ্ধ হয়ে দেখেই চলেছি দেবপ্রয়াগ, কানে আসছে দুই ধারার মিলনের গমগমে আওয়াজ। কেটে গেল কতক্ষণ… কিন্তু এখনও প্রায় ১২০ কিলোমিটার রাস্তা গেলে তবে পৌছাব আজ রাতের আশ্রয়ে। কাজেই চরৈবেতি।
ঋষিকেশ থেকে দেবপ্রয়াগ পর্যন্ত আমাদের রাস্তার বামপাশে ছিল হিমালয়ের প্রাচীর, ডানপাশে খাদের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গা। এখন আমরা চলব ডানদিকে অলকানন্দাকে রেখে। এইভাবে আরও ২৮ কিলোমিটার চলে কীর্তিনগর। কীর্তিনগরে এসে পুল পেরিয়ে অলকানন্দাকে বামহাতে রেখে ছুটে চলল আমাদের গাড়ি। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ পৌঁছলাম শ্রীনগর। কাশ্মীরের নয়, এই শ্রীনগর গাড়োয়ালের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যনগরী। শ্রীনগর ছাড়াতেই হিমালয়ের সৌন্দর্য যেন আরও বেড়ে গেল। পাহাড়ের গা সবুজে সবুজ, বনে বনে নিবিড়। মাঝে মাঝে নেমে এসেছে দুএকটা ঝর্না। কোথাও কোথাও পাথুরে পথ চড়াই ভেঙে উঠে গেছে কোন পাহাড়ি গ্রামে। বাঁদিকে অলকানন্দার সবুজ স্রোত। শ্রীনগর থেকে রুদ্রপ্রয়াগ ৩৩ কিলোমিটার। মাঝে দুটি বড় জনপদ পড়ে, কালিয়াসৌর ও অগস্তমুনি। কালিয়াসৌরে আছে বিখ্যাত ধারিদেবীর মন্দির।
ধারিদেবীকে বলা হয় উত্তরাখণ্ডের চারধামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। ধারণকারিণী অর্থে ধারি। দেবীকে প্রথম পাওয়া গিয়েছিল অলকানন্দার গর্ভে। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী প্রাপক ব্রাহ্মণ অলকানন্দার নদীগর্ভেই তাঁর আরাধনার প্রচলন করেন। কয়েক বছর আগে স্থানীয় প্রশাসন উদ্যোগ নেয় নদীগর্ভ থেকে দেবীকে তুলে এনে শহরের মধ্যে ভব্য মন্দির নির্মাণ করে সেখানেই তাঁর পূজা অর্চনার ব্যবস্থা করতে। স্থানীয় মানুষ প্রথমে বাধা দেয়, কারণ জনশ্রুতি বলে যে ধারিদেবীকে তাঁর নিজের জায়গা থেকে সরালেই বিপর্যয় নেমে আসে (১৮৮২ সালে এইরকম চেষ্টা করা হয়েছিল, সেসময় নাকি প্রবল ধসের শিকার হয় উত্তরাখণ্ড)। যাইহোক, বাধাবিঘ্ন এড়িয়ে ২০১৩ সালের ১৬ই জুন সন্ধ্যার সময় দেবীকে তাঁর আদি মন্দির থেকে সরানো হয়। ১৭ই জুন প্রলয়ঙ্কর বন্যা ধ্বংস করে দেয় কেদারনাথ উপত্যকা। এরপর আবার দেবীকে ফিরিয়ে আনা হয় তাঁর আদি মন্দিরে।
অগস্তমুনি পেরোনোর পরই ধসপ্রবন পাহাড় শুরু হয়ে যায়।সাধারনত দুধরণের পাহাড় থেকে ধস নামার সম্ভাবনা বেশি। একটা হল এইরকম মাটির পাহাড়, বা চুনাপাথরের পাহাড়, এর মাটির রঙ সাদা। দেখলেই বোঝা যায় অত্যন্ত নরম। সিরোবাগাড়ের পাহাড় এই ধরনের। আরেকধরনের ধস প্রবণ পাহাড়কে বলা যায় ‘খাজা-পাহাড়’। পাথুরে পাহাড়, কিন্তু দেওয়ালের গায়ে স্তরে স্তরে পাথর যেন ভাঁজে ভাঁজে গুঁজে দেওয়া রয়েছে, খাজার মতন অনেকটা। এই পাহাড় দেখলেই মনে হয় এইবুঝি হুড়মুড় করে নেমে আসবে, যেমন অগোছালো বইয়ের তাক থেকে বই পড়ে যায় হুড়মুড় করে।
যাইহোক রুদ্রপ্রয়াগ আর মাত্র 20 কিলোমিটার।রুদ্রপ্রয়াগ দুই যুগে দুই বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। পৌরাণিক যুগে এই রুদ্রপ্রয়াগেই রুদ্রনাথ মহাদেব সৃষ্টি করেছিলেন রাগ রাগিণীর। পরবর্তীকালে দেবর্ষি নারদও এই রুদ্রপ্রয়াগেই তপস্যায় তুষ্ট করে আশুতোষ শিবের কাছে সঙ্গীতের জ্ঞান লাভ করেছিলেন বলে কথিত আছে। এযুগে রুদ্রপ্রয়াগ বিখ্যাত জিম করবেটের জন্য।
ভারতপ্রেমী সাহেব জিম করবেট এই রুদ্রপ্রয়াগেই মানুষখেকো লেপার্ড মেরেছিলেন ১৯২৬ সালে। লেপার্ডটি মরার আগে অন্তত ১২৫ জন মানুষ মেরেছিল বলে শোনা যায়। জিম করবেটের লেখা ‘দি ম্যান ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ’ অথবা মহাশ্বেতা দেবীর অনুবাদ করা ‘রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো চিতা’ পড়েনি এমন লোক বিরল। এককালে করবেটকে গাড়োয়ালের মানুষ দেবতার মতন ভক্তি করত। সঙ্গমের থেকে মাইল খানেক আগেই যে জায়গাটায় লেপার্ডটাকে মেরেছিলেন করবেট, সেখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ করে দিয়েছিল সরকার। রুদ্রপ্রয়াগ পৌছালাম তখন বেলা একটা বাজতে চলেছে। রুদ্রপ্রয়াগে অলকানন্দা ও মন্দাকিনী নদীর সঙ্গম। রাস্তাও এখানে এসে দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। মন্দাকিনীর তীরে তীরে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে কেদারনাথের পথে। অলকানন্দার ধার বরাবর আরেকটা রাস্তা চলে গিয়েছে বদ্রীনাথ।পথের ধারে একটা ধাবায় লাঞ্চটা সেরে কেদারনাথের রাস্তাটা ধরলাম।এইবার আমাদের সামনে প্রথমবারের জন্য এলো মন্দাকিনী। ঠিক যেন উচ্ছলা, খামখেয়ালি এক কিশোরী। ভাগীরথীর স্নেহ সুশীতল ছায়া নেই তার বুকে, নেই পুর্ণযৌবন অলকানন্দার স্থৈর্য। মন্দাকিনীর পরিচয় তার দ্রুত লয়ের নৃত্যে, দুধ-সাদা অমৃতধারার চোখ-ঝলসানো রূপে, তার নবযৌবনের অহঙ্কারে, তার হঠাৎ রেগে ওঠায়, আবার হঠাৎ গলে জল হয়ে যাওয়ায়। তার প্রচণ্ড রাগে অথবা অভিমানে কয়েকবছর আগেই কেঁপে গিয়েছিল কেদারনাথ উপত্যকা সহ গোটা উত্তরাখণ্ড রাজ্যটা, তার স্মৃতি দুদিকে চোখে পড়ছে হরবকত। তবুও আমি বলতে বাধ্য, প্রথম দর্শনেই মন্দাকিনীকে ভালবেসেছি।
রুদ্রপ্রয়াগের সঙ্গম এই সময় আমাদের দেখা হলনা। এখন আমাদের গাড়ি চলেছে মন্দাকিনীকে বাঁহাতে রেখে। এভাবে যাবে আরও ৩৫ কিলোমিটার, কুণ্ড চটি পর্যন্ত। সেখান থেকে মন্দাকিনী চলে যাবে আমাদের ডানদিকে। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে পথের দৃশ্য বেশ খানিকটা বদলে গেছে। গাছপালার সংখ্যা অনেক বেশী। বেশিরভাগ জায়গায়ই মনে হচ্ছে সুপরিকল্পিত কোনও বনপথ দিয়ে আমরা চলেছি। গোটা যাত্রাপথে দেখেছি অগুনতি ক্রেন, বুলডোজার, আর ঝাড়ু ও গাইতি হাতে অসংখ্য কর্মী। যদিও চারধাম প্রজেক্টের দক্ষযজ্ঞে রাস্তার হাল অতীব খারাপ। গাড়িতে যাচ্ছি নৌকাবিহার করছি ঠিক ঠাহর করতে পারছিলাম না। একফাঁকে একটু ছোট্ট করে কেদারনাথের পৌরাণিক গল্পটা বলে নি -কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর জ্ঞাতিহত্যার পাপ স্খালন করতে পাণ্ডবেরা তীর্থদর্শনে বেরলেন। বিভিন্ন তীর্থ দর্শনের পর তারা এসে পৌঁছালেন কাশীতে। সত্যদ্রষ্টা যুধিষ্ঠির কিন্তু জানতে পারলেন বিশ্বনাথ শিব তাঁদের দেখা দেবেন না বলে হিমালয়ে আত্মগোপন করেছেন। অগত্যা পাণ্ডবেরা হরিদ্বারের পথে এসে হিমালয়ে খুজে বেড়াতে লাগলেন কাশীশ্বর বিশ্বনাথকে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যুধিষ্ঠির জানতে পারলেন গুপ্তকাশিতে বিশ্বনাথ এক বৃষের ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছেন। পঞ্চপাণ্ডব সেই বৃষের পিছনে ধাওয়া করল।গৌরীকুণ্ডের কাছে এসে মধ্যম পাণ্ডব ভীম দেখলেন তাঁদের এড়ানোর জন্য সেই বৃষ মাটিতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। ভীম ছাড়বার পাত্র নন। জাপটে ধরলেন সেই বৃষকে। তারপর তার লেজ ধরে চলতে লাগল টানাটানি। এই টানাটানির ফলে মাটি বিদীর্ণ হয়ে উঠে এলো বৃষরূপী মহাদেবের দেহ। সেই বৃষের পিঠের কুজ রইল কেদারনাথে, জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে। তাই কেদারনাথের শিবলিঙ্গ দেখতে বৃষের পিঠের কুজের মতন। বৃষের নাভি প্রকাশিত হল মধ্য-মহেশ্বর বা মদ মহেশ্বর রূপে। দুহাত প্রতিষ্ঠিত হল তুঙ্গনাথে। মুখ রুদ্রনাথে, ও জটা প্রকাশিত হল কল্পেশ্বরে। কেদারনাথ, মদমহেশ্বর, তুঙ্গনাথ, রুদ্রনাথ ও কল্পেশ্বর এই পাঁচ তীর্থস্থান নিয়ে হল পঞ্চকেদার।একটা লোহার সেতু পেরিয়ে আমরা পৌছালাম কুণ্ডচটিতে। এখন থেকে মন্দাকিনী আমাদের ডানদিকে। পথে পেরিয়ে এসেছি আরও একটা অগস্ত্যমুনি নামের জনপদ, এবং সৌড়ি নামের পাহাড়ি শহর। মন্দাকিনীর ঠিক ওপারে রয়েছে আরেকটি শহর। নাম উখিমঠ। উখিমঠ থেকে একটি রাস্তা চলে গিয়েছে চোপ্তা হয়ে গোপেশ্বরে। যারা কেদারনাথ থেকে সরাসরি বদ্রীনাথ যায়, তারা এই পথে গোপেশ্বর হয়ে বদ্রীনাথের মূলপথে ওঠে। এছাড়া চোপ্তা থেকে মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটার ট্রেক করে পৌঁছানো যায় তৃতীয় কেদার তুঙ্গনাথে।
কুণ্ড থেকে গুপ্তকাশী মাত্র সাত কিলোমিটার, পৌছালাম যখন তখন বেলা প্রায় চারটে। রুদ্রপ্রয়াগ ছাড়ানোর পর থেকেই আকাশে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। গুপ্তকাশী পৌঁছে দু এক ফোঁটা পড়তে আরম্ভ করল। আস্তে আস্তে বেগ বাড়তে থাকলো সাথে গাড়িও চলতে থাকলো।পথে পড়ল কালিমঠ, এখান থেকেই দ্বিতীয় কেদার মদমহেশ্বর যাওয়ার রাস্তা। কালিমঠ পেরিয়ে এলাম নালাচটিতে। একটা পাহাড়ি ঝর্নার ধারে দাঁড়িয়ে হিমালয়ের কোলের নিবিড় স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করলাম খানিক। বৃষ্টি তখন ধরে এসেছে।
নালার পরবর্তী চটির নাম ফাটা। এই ফাটা চটি থেকেই কেদারনাথ যাওয়ার হেলিকপটার যাতায়াত করে। আমাদের ওনলাইনে হেলিকপ্টার বুকিং না থাকার কারনে ফাটা থেকেই অফলাইন বুকিং করতে হবে। কিন্তু ৫ টা বেজে যাওয়ার কারনে কাউন্টার বন্ধ। খোজ নিয়ে জানলাম পরের দিন ভোর ৫ টা থেকে লাইন পড়ে।তাই ঠিক করলাম ফাটার আশেপাশে কোথাও আজকের মতো যাত্রাবিরতি দেবো। কাউন্টারের উলটোদিকে একটি ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে চায়ের অর্ডার দিয়ে দোকানির কাছে খোজখবর নিতে বসলাম। দোকানির একটা টিপস পরের দিন মিরাকলের মতো কাজ করেছিলো।
ফাটা থেকে বারসু ৩ কিলোমিটার। পাহাড়ের গায়ে বেশ নির্জন একটা জায়গায় গাড়ি থামালাম। সামনে একটা ছোটখাটো থাকার জায়গা। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে তখন, জিজ্ঞাসা করে জানা গেল ভাত, রুটি হতে ঘন্টাদুয়েক সময় লাগবে। আরেকরাউন্ড চায়ের অর্ডার দিয়ে আমরা ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। আমরা একতলায় ঘর নিলাম। ঘরের সামনে ব্যালকনি, সামনেই মন্দাকিনীর নদীখাত।ঘরে ঢুকেও মনটা আরেকবার খুশি হয়ে গেল। বেশ তোফা ব্যবস্থা। তুলতুলে গদি, নতুন কম্বল, গরম জল, পর্যাপ্ত প্লাগপয়েন্ট আর কি চাই। লোডশেডিং হলে এমার্জেন্সি চার্জার লাইটের ব্যবস্থাও নাকি আছে। যাইহোক পরের দিনের যুদ্ধের জন্য শক্তিসঞ্চয় হেতু তাড়াতাড়ি লাউকির তরকারি,রাজমা, চাউল দিয়ে ডিনার সেরে নিদ্রাদেবীর আরাধনায় ব্রতী হলাম।
শুরুতেই হর কি পউড়ির পাশেই বিশাল শিবমূর্তি, বরাভয় মুদ্রায়। আমরা চলতি গাড়ি থেকেই মনে মনে প্রণাম জানিয়ে এগিয়ে চললাম। প্রথম গন্তব্য ঋষিকেশ, হরিদ্বার থেকে দূরত্ব কুড়ি কিলোমিটার। রাস্তার উপর সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে কেদারনাথ ২৫৩ কিলোমিটার। হরিদ্বার থেকে ঋষিকেশ পর্যন্ত রাস্তা সমতল দিয়েই চলেছে। ডানদিকে গঙ্গা কিছুটা দূর দিয়ে বয়ে চলেছে, বামদিকে মনসা পাহাড়ের সঙ্গী সাথীরা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে, ওদের একটা পোশাকি নাম আছে, মতিচুর রেঞ্জ। মতিচুর রেঞ্জ আসলে শিবালিক রেঞ্জেরই দক্ষিণভাগের একটা অংশ। আর আছে পথের দুদিকে গভীর অরণ্য, রাজাজী ন্যাশানাল পার্ক। এই অরণ্যের মধ্যে দিয়ে পাশাপাশি ছুটে চলেছে আমাদের রাস্তা আর হরিদ্বার থেকে দেরাদুনের রেলপথ। পথের ধারে ধারে সাইনবোর্ড ঝোলানো, ‘বুনোহাতির থেকে সাবধান’। এই জঙ্গলে নাকি প্রচুর হাতি আছে। তাই গাড়ি আর ট্রেন দুটোই চলে সতর্ক হয়ে ধীরে ধীরে।আধঘণ্টার মধ্যেই আমরা ঋষিকেশ। চন্দ্রভাগা নদীর ব্রীজ, মুনি কি রেতি পার হয়ে লছমন ঝোলাকে ডানহাতে রেখে আমরা এগিয়ে চললাম ব্যাসীর দিকে। ঋষিকেশ পেরিয়ে আমরা আস্তে আস্তে হিমালয়ের গভীরে ঢুকতে শুরু করলাম। ঋষিকেশ থেকে ব্যাসী ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা। এই ৩৫ কিলোমিটারের প্রায় পুরোটাই রাস্তার ধারে বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপনের হোডিং। অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের বিজ্ঞাপন। বর্তমানের ঋষিকেশ বিখ্যাত বিদেশী ‘ইয়োগী’ আর অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্য। বাঞ্জি জাম্পিং, ফ্লাইং ফক্স, রিভার র্যাফটিং, ফরেস্ট ক্যাম্পিং কী নেই সেই তালিকায়। এরই মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে গাড়ি সাইড করলাম। এখানে রাস্তা গঙ্গার কিনারা থেকে খুবই কাছে, বাঁদিকে হিমালয়ের প্রাচীর, ডানদিক দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গার সনাতনী ধারা। সেধারার কুলুকুলু শব্দ ছাড়া একটাও শব্দ নেই কোনদিকে। সামনে কিছটা আগে একটা তারের ঝোলা সেতু বেয়ে একটা পায়ে চলা পথ চলে গেছে গঙ্গার ওপারে কোন পাহাড়ি গ্রামে।
সকাল সাড়ে নটায় পৌছালাম ব্যাসী। দ্বাপর যুগে ব্যাসী ছিল মহাভারত রচয়িতা বেদব্যাসের তপোস্থলী। এই ঘোরকলিতেও ব্যাসীতে বেদব্যাস বর্তমান, একটি শ্বেতপাথরের ব্যাসমূর্তিরূপে। তার দুটি হাত জড়ো করা, সেখান থেকে নেমে আসছে শীতল জলধারা। বেদব্যাস বর্তমানে তীর্থযাত্রীদের হাতে জল দিয়ে থাকেন।
ব্যাসী ছাড়িয়ে আমরা চললাম দেবপ্রয়াগের পথে। আঁকাবাঁকা পথ, ধীরে ধীরে চড়াইয়ের পথে উঠে চলেছে। রাস্তার প্রতিটি বাঁকে অপেক্ষা করে রয়েছে বিস্ময়। একদিকে মাথা উঁচু করে রয়েছে হিমালয়ের অভ্রভেদী চূড়া, ডানদিকে অতল খাদ, তার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা। এখানে হিমালয় সবুজে সবুজ। পাহাড়ের গায়ে নিরাবরণ পাথরের স্তর নেই বললেই চলে। গাছপাতার ফাঁক দিয়ে রোদের রশ্মি এসে পড়েছে পিচঢালা মসৃণ পথের উপর। ব্যাসী থেকে দেবপ্রয়াগ ৩৯ কিলোমিটার। বেলা সাড়ে দশটায় রাস্তার একপাশে গাড়ি থামিয়ে দাড়িয়ে পরলাম।গাড়ি থেকে নেমে ডানদিকে তাকাতেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম দেবপ্রয়াগের অপার সৌন্দর্যে। বাঁদিক থেকে ভাগীরথী, ডানদিক থেকে অলকানন্দা এসে মিলেছে দেবপ্রয়াগ সঙ্গমে। মাঝখানে ত্রিভুজাকার পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট শহর দেবপ্রয়াগ। ত্রিভুজাকার পাহাড়টা সবুজে সবুজ। তার পিছনে দেখা যাচ্ছে দূরের দূরের নীল রঙের সব পাহাড়চূড়া, একটার পর একটা। ভাগীরথীর জল খানিক ঘোলা, অলকানন্দার জল সবুজাভ।
সঙ্গমে দুই নদীর জলের বিভেদ স্পষ্ট। এই সঙ্গমেই উৎপত্তি পতিতপাবনী গঙ্গার। (গঙ্গোত্রী থেকে ভাগিরথীর উৎপত্তি, দেবপ্রয়াগে ভাগীরথীর সঙ্গে অলকানন্দা ও মন্দাকিনীর মিলিত ধারা একত্রে অলকানন্দা নামে মিশে গঙ্গার সৃষ্টি করেছে)। চারজনে মুগ্ধ হয়ে দেখেই চলেছি দেবপ্রয়াগ, কানে আসছে দুই ধারার মিলনের গমগমে আওয়াজ। কেটে গেল কতক্ষণ… কিন্তু এখনও প্রায় ১২০ কিলোমিটার রাস্তা গেলে তবে পৌছাব আজ রাতের আশ্রয়ে। কাজেই চরৈবেতি।
ঋষিকেশ থেকে দেবপ্রয়াগ পর্যন্ত আমাদের রাস্তার বামপাশে ছিল হিমালয়ের প্রাচীর, ডানপাশে খাদের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গা। এখন আমরা চলব ডানদিকে অলকানন্দাকে রেখে। এইভাবে আরও ২৮ কিলোমিটার চলে কীর্তিনগর। কীর্তিনগরে এসে পুল পেরিয়ে অলকানন্দাকে বামহাতে রেখে ছুটে চলল আমাদের গাড়ি। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ পৌঁছলাম শ্রীনগর। কাশ্মীরের নয়, এই শ্রীনগর গাড়োয়ালের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যনগরী। শ্রীনগর ছাড়াতেই হিমালয়ের সৌন্দর্য যেন আরও বেড়ে গেল। পাহাড়ের গা সবুজে সবুজ, বনে বনে নিবিড়। মাঝে মাঝে নেমে এসেছে দুএকটা ঝর্না। কোথাও কোথাও পাথুরে পথ চড়াই ভেঙে উঠে গেছে কোন পাহাড়ি গ্রামে। বাঁদিকে অলকানন্দার সবুজ স্রোত। শ্রীনগর থেকে রুদ্রপ্রয়াগ ৩৩ কিলোমিটার। মাঝে দুটি বড় জনপদ পড়ে, কালিয়াসৌর ও অগস্তমুনি। কালিয়াসৌরে আছে বিখ্যাত ধারিদেবীর মন্দির।
ধারিদেবীকে বলা হয় উত্তরাখণ্ডের চারধামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। ধারণকারিণী অর্থে ধারি। দেবীকে প্রথম পাওয়া গিয়েছিল অলকানন্দার গর্ভে। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী প্রাপক ব্রাহ্মণ অলকানন্দার নদীগর্ভেই তাঁর আরাধনার প্রচলন করেন। কয়েক বছর আগে স্থানীয় প্রশাসন উদ্যোগ নেয় নদীগর্ভ থেকে দেবীকে তুলে এনে শহরের মধ্যে ভব্য মন্দির নির্মাণ করে সেখানেই তাঁর পূজা অর্চনার ব্যবস্থা করতে। স্থানীয় মানুষ প্রথমে বাধা দেয়, কারণ জনশ্রুতি বলে যে ধারিদেবীকে তাঁর নিজের জায়গা থেকে সরালেই বিপর্যয় নেমে আসে (১৮৮২ সালে এইরকম চেষ্টা করা হয়েছিল, সেসময় নাকি প্রবল ধসের শিকার হয় উত্তরাখণ্ড)। যাইহোক, বাধাবিঘ্ন এড়িয়ে ২০১৩ সালের ১৬ই জুন সন্ধ্যার সময় দেবীকে তাঁর আদি মন্দির থেকে সরানো হয়। ১৭ই জুন প্রলয়ঙ্কর বন্যা ধ্বংস করে দেয় কেদারনাথ উপত্যকা। এরপর আবার দেবীকে ফিরিয়ে আনা হয় তাঁর আদি মন্দিরে।
অগস্তমুনি পেরোনোর পরই ধসপ্রবন পাহাড় শুরু হয়ে যায়।সাধারনত দুধরণের পাহাড় থেকে ধস নামার সম্ভাবনা বেশি। একটা হল এইরকম মাটির পাহাড়, বা চুনাপাথরের পাহাড়, এর মাটির রঙ সাদা। দেখলেই বোঝা যায় অত্যন্ত নরম। সিরোবাগাড়ের পাহাড় এই ধরনের। আরেকধরনের ধস প্রবণ পাহাড়কে বলা যায় ‘খাজা-পাহাড়’। পাথুরে পাহাড়, কিন্তু দেওয়ালের গায়ে স্তরে স্তরে পাথর যেন ভাঁজে ভাঁজে গুঁজে দেওয়া রয়েছে, খাজার মতন অনেকটা। এই পাহাড় দেখলেই মনে হয় এইবুঝি হুড়মুড় করে নেমে আসবে, যেমন অগোছালো বইয়ের তাক থেকে বই পড়ে যায় হুড়মুড় করে।
যাইহোক রুদ্রপ্রয়াগ আর মাত্র 20 কিলোমিটার।রুদ্রপ্রয়াগ দুই যুগে দুই বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। পৌরাণিক যুগে এই রুদ্রপ্রয়াগেই রুদ্রনাথ মহাদেব সৃষ্টি করেছিলেন রাগ রাগিণীর। পরবর্তীকালে দেবর্ষি নারদও এই রুদ্রপ্রয়াগেই তপস্যায় তুষ্ট করে আশুতোষ শিবের কাছে সঙ্গীতের জ্ঞান লাভ করেছিলেন বলে কথিত আছে। এযুগে রুদ্রপ্রয়াগ বিখ্যাত জিম করবেটের জন্য।
ভারতপ্রেমী সাহেব জিম করবেট এই রুদ্রপ্রয়াগেই মানুষখেকো লেপার্ড মেরেছিলেন ১৯২৬ সালে। লেপার্ডটি মরার আগে অন্তত ১২৫ জন মানুষ মেরেছিল বলে শোনা যায়। জিম করবেটের লেখা ‘দি ম্যান ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ’ অথবা মহাশ্বেতা দেবীর অনুবাদ করা ‘রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো চিতা’ পড়েনি এমন লোক বিরল। এককালে করবেটকে গাড়োয়ালের মানুষ দেবতার মতন ভক্তি করত। সঙ্গমের থেকে মাইল খানেক আগেই যে জায়গাটায় লেপার্ডটাকে মেরেছিলেন করবেট, সেখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ করে দিয়েছিল সরকার। রুদ্রপ্রয়াগ পৌছালাম তখন বেলা একটা বাজতে চলেছে। রুদ্রপ্রয়াগে অলকানন্দা ও মন্দাকিনী নদীর সঙ্গম। রাস্তাও এখানে এসে দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। মন্দাকিনীর তীরে তীরে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে কেদারনাথের পথে। অলকানন্দার ধার বরাবর আরেকটা রাস্তা চলে গিয়েছে বদ্রীনাথ।পথের ধারে একটা ধাবায় লাঞ্চটা সেরে কেদারনাথের রাস্তাটা ধরলাম।এইবার আমাদের সামনে প্রথমবারের জন্য এলো মন্দাকিনী। ঠিক যেন উচ্ছলা, খামখেয়ালি এক কিশোরী। ভাগীরথীর স্নেহ সুশীতল ছায়া নেই তার বুকে, নেই পুর্ণযৌবন অলকানন্দার স্থৈর্য। মন্দাকিনীর পরিচয় তার দ্রুত লয়ের নৃত্যে, দুধ-সাদা অমৃতধারার চোখ-ঝলসানো রূপে, তার নবযৌবনের অহঙ্কারে, তার হঠাৎ রেগে ওঠায়, আবার হঠাৎ গলে জল হয়ে যাওয়ায়। তার প্রচণ্ড রাগে অথবা অভিমানে কয়েকবছর আগেই কেঁপে গিয়েছিল কেদারনাথ উপত্যকা সহ গোটা উত্তরাখণ্ড রাজ্যটা, তার স্মৃতি দুদিকে চোখে পড়ছে হরবকত। তবুও আমি বলতে বাধ্য, প্রথম দর্শনেই মন্দাকিনীকে ভালবেসেছি।
রুদ্রপ্রয়াগের সঙ্গম এই সময় আমাদের দেখা হলনা। এখন আমাদের গাড়ি চলেছে মন্দাকিনীকে বাঁহাতে রেখে। এভাবে যাবে আরও ৩৫ কিলোমিটার, কুণ্ড চটি পর্যন্ত। সেখান থেকে মন্দাকিনী চলে যাবে আমাদের ডানদিকে। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে পথের দৃশ্য বেশ খানিকটা বদলে গেছে। গাছপালার সংখ্যা অনেক বেশী। বেশিরভাগ জায়গায়ই মনে হচ্ছে সুপরিকল্পিত কোনও বনপথ দিয়ে আমরা চলেছি। গোটা যাত্রাপথে দেখেছি অগুনতি ক্রেন, বুলডোজার, আর ঝাড়ু ও গাইতি হাতে অসংখ্য কর্মী। যদিও চারধাম প্রজেক্টের দক্ষযজ্ঞে রাস্তার হাল অতীব খারাপ। গাড়িতে যাচ্ছি নৌকাবিহার করছি ঠিক ঠাহর করতে পারছিলাম না। একফাঁকে একটু ছোট্ট করে কেদারনাথের পৌরাণিক গল্পটা বলে নি -কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর জ্ঞাতিহত্যার পাপ স্খালন করতে পাণ্ডবেরা তীর্থদর্শনে বেরলেন। বিভিন্ন তীর্থ দর্শনের পর তারা এসে পৌঁছালেন কাশীতে। সত্যদ্রষ্টা যুধিষ্ঠির কিন্তু জানতে পারলেন বিশ্বনাথ শিব তাঁদের দেখা দেবেন না বলে হিমালয়ে আত্মগোপন করেছেন। অগত্যা পাণ্ডবেরা হরিদ্বারের পথে এসে হিমালয়ে খুজে বেড়াতে লাগলেন কাশীশ্বর বিশ্বনাথকে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যুধিষ্ঠির জানতে পারলেন গুপ্তকাশিতে বিশ্বনাথ এক বৃষের ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছেন। পঞ্চপাণ্ডব সেই বৃষের পিছনে ধাওয়া করল।গৌরীকুণ্ডের কাছে এসে মধ্যম পাণ্ডব ভীম দেখলেন তাঁদের এড়ানোর জন্য সেই বৃষ মাটিতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। ভীম ছাড়বার পাত্র নন। জাপটে ধরলেন সেই বৃষকে। তারপর তার লেজ ধরে চলতে লাগল টানাটানি। এই টানাটানির ফলে মাটি বিদীর্ণ হয়ে উঠে এলো বৃষরূপী মহাদেবের দেহ। সেই বৃষের পিঠের কুজ রইল কেদারনাথে, জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে। তাই কেদারনাথের শিবলিঙ্গ দেখতে বৃষের পিঠের কুজের মতন। বৃষের নাভি প্রকাশিত হল মধ্য-মহেশ্বর বা মদ মহেশ্বর রূপে। দুহাত প্রতিষ্ঠিত হল তুঙ্গনাথে। মুখ রুদ্রনাথে, ও জটা প্রকাশিত হল কল্পেশ্বরে। কেদারনাথ, মদমহেশ্বর, তুঙ্গনাথ, রুদ্রনাথ ও কল্পেশ্বর এই পাঁচ তীর্থস্থান নিয়ে হল পঞ্চকেদার।একটা লোহার সেতু পেরিয়ে আমরা পৌছালাম কুণ্ডচটিতে। এখন থেকে মন্দাকিনী আমাদের ডানদিকে। পথে পেরিয়ে এসেছি আরও একটা অগস্ত্যমুনি নামের জনপদ, এবং সৌড়ি নামের পাহাড়ি শহর। মন্দাকিনীর ঠিক ওপারে রয়েছে আরেকটি শহর। নাম উখিমঠ। উখিমঠ থেকে একটি রাস্তা চলে গিয়েছে চোপ্তা হয়ে গোপেশ্বরে। যারা কেদারনাথ থেকে সরাসরি বদ্রীনাথ যায়, তারা এই পথে গোপেশ্বর হয়ে বদ্রীনাথের মূলপথে ওঠে। এছাড়া চোপ্তা থেকে মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটার ট্রেক করে পৌঁছানো যায় তৃতীয় কেদার তুঙ্গনাথে।
কুণ্ড থেকে গুপ্তকাশী মাত্র সাত কিলোমিটার, পৌছালাম যখন তখন বেলা প্রায় চারটে। রুদ্রপ্রয়াগ ছাড়ানোর পর থেকেই আকাশে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। গুপ্তকাশী পৌঁছে দু এক ফোঁটা পড়তে আরম্ভ করল। আস্তে আস্তে বেগ বাড়তে থাকলো সাথে গাড়িও চলতে থাকলো।পথে পড়ল কালিমঠ, এখান থেকেই দ্বিতীয় কেদার মদমহেশ্বর যাওয়ার রাস্তা। কালিমঠ পেরিয়ে এলাম নালাচটিতে। একটা পাহাড়ি ঝর্নার ধারে দাঁড়িয়ে হিমালয়ের কোলের নিবিড় স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করলাম খানিক। বৃষ্টি তখন ধরে এসেছে।
নালার পরবর্তী চটির নাম ফাটা। এই ফাটা চটি থেকেই কেদারনাথ যাওয়ার হেলিকপটার যাতায়াত করে। আমাদের ওনলাইনে হেলিকপ্টার বুকিং না থাকার কারনে ফাটা থেকেই অফলাইন বুকিং করতে হবে। কিন্তু ৫ টা বেজে যাওয়ার কারনে কাউন্টার বন্ধ। খোজ নিয়ে জানলাম পরের দিন ভোর ৫ টা থেকে লাইন পড়ে।তাই ঠিক করলাম ফাটার আশেপাশে কোথাও আজকের মতো যাত্রাবিরতি দেবো। কাউন্টারের উলটোদিকে একটি ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে চায়ের অর্ডার দিয়ে দোকানির কাছে খোজখবর নিতে বসলাম। দোকানির একটা টিপস পরের দিন মিরাকলের মতো কাজ করেছিলো।
ফাটা থেকে বারসু ৩ কিলোমিটার। পাহাড়ের গায়ে বেশ নির্জন একটা জায়গায় গাড়ি থামালাম। সামনে একটা ছোটখাটো থাকার জায়গা। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে তখন, জিজ্ঞাসা করে জানা গেল ভাত, রুটি হতে ঘন্টাদুয়েক সময় লাগবে। আরেকরাউন্ড চায়ের অর্ডার দিয়ে আমরা ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। আমরা একতলায় ঘর নিলাম। ঘরের সামনে ব্যালকনি, সামনেই মন্দাকিনীর নদীখাত।ঘরে ঢুকেও মনটা আরেকবার খুশি হয়ে গেল। বেশ তোফা ব্যবস্থা। তুলতুলে গদি, নতুন কম্বল, গরম জল, পর্যাপ্ত প্লাগপয়েন্ট আর কি চাই। লোডশেডিং হলে এমার্জেন্সি চার্জার লাইটের ব্যবস্থাও নাকি আছে। যাইহোক পরের দিনের যুদ্ধের জন্য শক্তিসঞ্চয় হেতু তাড়াতাড়ি লাউকির তরকারি,রাজমা, চাউল দিয়ে ডিনার সেরে নিদ্রাদেবীর আরাধনায় ব্রতী হলাম।
This comment has been removed by a blog administrator.
ReplyDelete