মান্ডুর প্রেম কথা


জাহাজ মহল



ইতিহাস কোনোদিনই আমার খুব প্রিয় সাবজেক্ট নয়। তাই ভ্রমনস্থল নির্বাচনে ইতিহাসের ছোঁয়াছুঁয়ি আমি একটু বাঁচিয়ে চলি। কিন্তু কিছু ট্রাভেল ব্লগ ঘাটতে ঘাটতে বিন্ধ্যপর্বতমালার শিখরে ঐতিহাসিক দুর্গনগরী মান্ডুর গল্পটাতে হঠাৎ করেই চোখটা আটকে গেলো৷রানি রূপমতী ও মালোয়ার রাজা বাজ বাহাদুরের প্রেমকাহিনি মিশে আছে মান্ডু-র আকাশে বাতাসে। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গিরের অতি প্রিয় ছিল এই মান্ডু, বিশেষ করে বর্ষাকালে। মুসলমান ঐতিহাসিক গুলাম ইয়াজদানি যাকে অভিহিত করেছিলেন 'শারাংপুর' বা 'আনন্দের শহর' বলে।জাহাঙ্গির যার নাম দিয়েছিলেন  সাদিয়াবাদ, অর্থাত্‍ সিটি অফ জয়।পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা মধ্যপ্রদেশের ধর জেলার দুর্গ শহর মান্ডু। দুর্গ হলেও এর প্রতিটা পাথরে আজও শোনা যায় রুপমতির নুপুরের শব্দ, বিন্ধের হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় তার গান, যা একসময় রাজপুতদের শেষ স্বাধীন রাজা বাজবাহাদুরকে মুগ্ধ করেছিল। ঐতিহাসিকদের মত অনুযায়ী মান্ডু দুর্গ দশম শতাব্দীর গোড়ার দিকে নির্মিত হয়েছিল৷ নির্মাণকালে এর নাম ছিল মণ্ডপ দুর্গ৷ মণ্ডপ থেকে হয় মাণ্ডব৷ আজকের গল্পের পটভুমি এই মান্ডব।

ইতিহাসে উকিঁঝুঁকি ঃ-
দশম শতাব্দীতে রাজা ভোজের হাতে দুর্গনগরী হিসাবে মান্ডুর অভ্যুত্থান।যা ১৩০৪ খ্রীস্টাব্দে দিল্লির তৎকালীন মুসলিম রাজাদের করায়ত্ব হয়। তবে ১৪০১ সালে মোঘলরা দিল্লী দখলের পর মালবার আফগান সেনাপতি দিলবার খান মালবাকে একটি স্বাধীন রাজ্য হিসাবে ঘোষনা করেন।
দিলবার খানের পুত্র হোসাং খান মালবা রাজ্যের রাজধানী 'ধর' থেকে মান্ডুতে সরিয়ে আনেন এবং তার হাতেই মান্ডুর স্বর্নযুগের সুচনা হয়। হোসং শাহের আমলে মান্ডু তার অর্থ, প্রতিপত্তি এবং ঐশ্বর্যে খ্যাতি লাভ করে।বলা হয় যে এখানে অবস্থিত হোসাং শাহের সমাধি নাকি ভারতের প্রথম শ্বেতপাথরে তৈরি সৌধ, যা দেখে সম্রাট শাহজাহান তাজমহল বানানোর অনুপ্রেরণা পান। হোসাং খানের পুত্র মহম্মদ মাত্র একবছর রাজত্ব করার পর মহম্মদ খিলজির চক্রান্তের শিকার হন এবং বিষপানে মৃত্যুবরন করেন।মহম্মদ খিলজির ৩৩ বছর রাজত্বকালের পর তার পুত্র সুলতান গিয়াসউদ্দিন খিলজী ১৩৬৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।
১৫২৬ সালে গুজরাতের বাহাদুর শাহ মান্ডু দখল করলেও ১৫৩৪ সালে সম্রাট হুমায়ুন আবার তা পুনরায় দখল করে নেন। এরপর অনেক হাত বদলের পর ১৫৫৪ সালে বাজ বাহাদুর ক্ষমতায় আসেন । বাজ বাহাদুর ছিলেন মান্ডুর শেষ স্বাধীন সুলতান ।১৫৬১ সালে বাজ বাহাদুর সম্রাট আকবরের সেনাবাহিনীর হাতে পরাজিত হন। তারপর থেকে ১৭৩২ সাল অব্দি মান্ডু মোঘল সম্রাজ্যের অধীনেই ছিলো। এরপর মান্ডু মারাঠাদের অধীনে আসে।মারাঠারা মালবা রাজ্যের রাজধানী আবার মান্ডু থেকে ধারে সরিয়ে নিয়ে যায় এবং মান্ডুর সৌভাগ্যলক্ষী অস্তমিত হয়।আস্তে আস্তে তা পরিত্যক্ত নগরীতে পর্যবসিত হয়।
হিন্দোলা মহল




দর্শনীয় স্থান ঃ-
মান্ডু দুর্গটি প্রায় ৪৫ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। রয়েছে ১২টি প্রবেশদ্বার। প্রধান প্রবেশদ্বারটি দিল্লি দরওয়াজা, এরপরেরটি আলমগির দরওয়াজা আর শেষেরটির নাম ভাঙ্গি দরওয়াজা৷ অসাধারণ নির্মানশৈলীর সাক্ষ্যবহনকারী সুন্দর এই দুর্গকে যুগের পর যুগ ধরে সুলতান, সম্রাট, রাজা, মহারাজারা তাদের রাজত্বকালে মান্ডুকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। নির্মাণ করেছেন একের পর এক অসামান্য স্থাপত্যকীর্তি। ৭৫টি ঐতিহাসিক সৌধ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে মান্ডুর নানান জায়গায়।ইন্দোর থেকে ৯৮ কি.মি. দুরত্বে অবস্থিত প্রাচীন ধংসপ্রাপ্ত দূর্গটি যেন সারা শহরটাকেই ঘিরে রেখেছে কোনো এক ভালবাসার মায়াবী আস্তরণে। আর প্রকৃতিও কার্পন্য করেনি তার অপার রূপের মহিমায় একে সাজাতে। প্রায় তিনহাজার বছর পুরানো এই দূর্গের পাথরে কান পাতলে শোনা যায় সেইসমস্ত শাসকদের পদশব্দের ইতিহাস।
দেখার সুবিধার জন্য মান্ডুকে ভাগ করা হয়েছে তিনটি ভাগে৷ যেমন-রেওয়াকুন্ড গ্রপ, সেন্ট্রাল গ্রপ আর রয়্যাল এনক্লেভ৷
ভিলেজ বা সেন্ট্রাল গ্রুপের মধ্যে পড়ে মান্ডুতে প্রবেশ করার তিন ফটক- আলমগির, দিল্লি ও ভাঙ্গি দরওয়াজা, আশরাফি মহল, রামমন্দির, দামাস্কাসের গ্রেট মস্কের অনুকরণে তৈরি জামি মসজিদ ও হোসাং শাহ-র সমাধি।মান্ডুর বাজার এলাকায় অবস্থিত এই দু'টি সৌধেরই জালির কাজ নজর করার মতো।হোসাং শাহ-র সমাধি ভারতে তৈরী প্রথম মার্বেল পাথরের সৌধ। আফগান শৈলীতে নির্মিত এই গম্বুজ ও ঝালরের সূক্ষ্ম কারুকার্যগুলো এতটাই নয়নাভিরাম যে চোখ ফেরানো যায় না। সম্রাট শাজাহান তাজমহল নির্মাণের আগে তার চার প্রধান স্থপতিকে এখানে পাঠিয়েছিলেন দেখে আসার জন্য।
রয়াল গ্রুপের মধ্যে পড়ে বিখ্যাত জাহাজ মহল।মান্ডুর সেরা স্থাপত্যকীর্তি হচ্ছে জাহাজমহল। ৷ সুলতান গিয়াসুদ্দিন খিলজী তৈরি করেন জাহাজমহল। মহলের দুই দিকে দুই জলাশয়- একদিকে মুঞ্জ তালাও ও অন্যদিকে কাপুরতালাও৷ দ্বিতল বিশাল প্রাসাদের টেরেসে দাঁড়িয়ে দুপাশে দুটি লেকের জলে তাকালে মনে হবে একটি জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন । এই দুই লেকের জলে নোঙর করা জাহাজমহল ছিলো হেরেমখানা। কাপুর তালাও আর মুঞ্জা তালাও-এর মাঝে অবস্থিত প্রায় ১২০ মিটার লম্বা এই প্রাসাদ। জলে পরিপূর্ণ তালাওয়ে যখন এর ছায়া ভাসে তখন মনে হয় যেন রাজ-তরী চলেছে।এর এক তলাটি তৈরি হয়েছিল শুধু গ্রানাইট আর লোহা দিয়ে৷ তবে দোতলা তৈরি হয় পাতলা ইট, চুন, সুরকি দিয়ে৷ দুটি সুইমিং পুল রয়েছে এখানে, একটি একতলায়, অন্যটি দোতলায়৷সুলতানি আমলে গানবাজনার আসর বসতো এখানে। হাজার হাজার প্রদীপ জ্বলত দোতলার বারান্দায়। আলো এসে পড়ত হ্রদের জলে।
আর আছে হিন্দোলা মহল।হিন্দোলা মহল হচ্ছে একটি দেওয়ানি দরবার হল। স্লোপিং দেওয়াল এবং পিলারের কারসাজি দেখে দেখে মনে হবে মহলটি দোদুল্যমান। তাই এর নাম হিন্দোলা মহল। স্যান্ড স্টোনের অপূর্ব কাজ মহলটিকে করেছে দৃষ্টি নন্দন। এমন সুন্দর তার গঠন শৈলী যে বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে এই বুঝি বাতাসের ছোঁয়ায় দুলে উঠল কোণাকুনি দেওয়াল সমেত মহল, কিন্তু ভেতরে গেলে দেখা যাবে দিব্বি সোজা দাঁড়িয়ে দেওয়াল।
মান্ডু-র দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত রেওয়া কুণ্ড গ্রুপের মধ্যে পড়ে বাজ বাহাদুরের প্রাসাদ ও রানি রূপমতীর প্যাভিলিয়ন।
এছাড়াও আরও অনেক উল্লেখযোগ্য সৌধ আছে মান্ডু জুড়ে, যেমন নীলকণ্ঠ প্রাসাদ ও মন্দির, আন্ধেরি ও উজালা বাউড়ি, দাই কে মহল, দাই কি ছোটি বহেন কে মহল, সাগর তালাও, এক খাম্বা মহল, দারিয়া খান মাকবারা, হাতি মহল ইত্যাদি।

রূপমতীর গল্প ঃ-
খিলজিরা একসময়ে শহরের নাম পাল্টে রাখে শাদিয়াবাদ অর্থাৎ 'আনন্দময় প্রেমনগরী'।তাদের নামমাহাত্যেই কি না জানি না মান্ডুকে কেন্দ্র করে জন্ম নেয় আস্ত এক প্রেম-উপাখ্যান যা ইতিহাসে রূপমতীর প্রেমউপাখ্যান নামে প্রসিদ্ধ।মান্ডুর সুলতান বাজবাহাদুর আর রানি রূপমতীর সেই প্রেমকাহিনী নিয়ে রয়েছে অনেক গল্প, লোকগাথা, চারনকবির গান, এমনকি চিত্রশিল্পেও নন্দিত হয়ে আছে। তবে শুধু দেশী গাথায় ও গানেই নয়, ক্রাম্প সাহেবও তাঁদের অমর করে গেছেন তাঁর "লেডি অব দ্যা লোটাসে"।
মান্ডুর শেষ স্বাধীন সুলতান ছিলেন বাজ বাহাদুর। সঙ্গীতের প্রতি তার ছিল অকুন্ঠ ভালবাসা । কুমারী রূপমতী ছিল এক অতি সাধারণ হিন্দু রাজপুত ঘরের অসাধারণ রূপসী তনয়া । তার গলার স্বরে ছিল এক অনবদ্য মিষ্টতা যা আকৃষ্ট করেছিল বাজ বাহাদুরকে । একদিন শিকারে বেরিয়েছিলেন বাজবাহাদুর । বাগাল,রাখাল বন্ধুদের সাথে রূপমতী গান গেয়ে খেলে বেড়াচ্ছিলেন সেই বনে । সুলতান তাকে দেখে তার সাথে রাজপুরীতে যেতে বললেন এবং তাকে বিয়ে করবেন জানালেন । রূপমতী একটি ছোট্ট শর্তে সুলতানের রাজধানী মান্ডু যেতে রাজী হলেন । রূপমতী রাজার প্রাসাদ থেকে কেবলমাত্র নর্মদা নদীকে দর্শন জানাবার বাসনা জানালেন । বাজ বাহাদুর সম্মত হলেন । সুলতান তার হবু বেগম রূপমতীর জন্য পাহাড়ের ওপরে বানালেন এক ঐশ্বরীয় রাজপ্রাসাদ যার নাম রূপমতী প্যাভিলিয়ন। এবং  রানি প্রতিদিন শাহিমহল থেকে এখানে এসে মা নর্মদাকে দর্শন করে তবে জলস্পর্শ করতেন । কিন্তু সমস্যা বাঁধল শীতের কুয়াশার সাথে বর্ষাকালে। রাশি রাশি অবুঝ মেঘগুলো নর্মদাকে প্রায় আড়াল করে রাখত। তখন রাজার আদেশেই কূপ খনন করে তাকে জুড়ে দেওয়া হলো মা নর্মদার সঙ্গে। বাজবাহাদুরের প্যালেসের সামনেই রয়েছে এই পবিত্র রেওয়া কুন্ড। হিন্দু এবং মুসলিম উভয় রীতি মেনে এই বিবাহ সম্পন্ন হলেও তাদের কিন্তু পরিণতি সুখকর হলনা । মোঘল সম্রাট আকবর দিল্লী থেকে অধম খানকে মান্ডুতে পাঠালেন শুধুমাত্র মান্ডু দখল করতেই নয় রূপমতীকে ছিনিয়ে আনতে । বীনা নামিয়ে রেখে অসি হাতে বাজবাহাদূর এগিয়ে গেলেন সারঙ্গপুরের যুদ্ধক্ষেত্রে। সেই যুদ্ধই সুলতানের শেষ যুদ্ধ। রূপমতী সেই খবর পেয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন । কবিতা আর গানের মধ্যে দিয়ে ভালোবাসার এক রূপকথার ভয়ানক পরিসমাপ্তি ঘটল ।হয়তো বা এখনো সেই মহলে ঘুরে বেড়ায় রানী রূপমতীর অতৃপ্ত আত্মা। 
কিভাবে যাবেন ঃ-
ইন্দোর থেকে মান্ডুর দুরত্ব ১০০ কিমি। বাস বা ভাড়া গাড়ি পাবেন এ পথে। বাস ভাড়া ৪০ টাকা আর ইন্দোর থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে মান্ডু গেলে খরচ পড়ে ১৫০০-২,০০০ টাকা।


কোথায় থাকবেন ঃ-
মান্ডুতে থাকার সেরা জায়গা মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল মালওয়া রিসর্ট, ভাড়া- ২,১৯০-৩,০৯০ টাকা, যোগাযোগ- ০৭২৯২-২৬৩২৩৫। হোটেল মালওয়া রিট্রিট, ভাড়া- ১,২৯০-২,২৯০ টাকা, যোগাযোগ- ০৭২৯২-২৬৩২২১।  হোটেল রুপমতী, ভাড়া- ১,৪০০-২,০০০ টাকা, যোগাযোগ- ০৭২৯২-২৬৩২৭০
এছাড়াও কিছু ছোট হোটেল ও লজ পাবেন যদিও তাদের সংখ্যা খুবই কম, তাই অগ্রিম বুকিং করে যাওয়াই বাঞ্চনীয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য ঃ-
বাজবাহাদূর-রূপমতীতে আবিষ্ট মনে ফেরার সময় এক অদ্ভুত গাছ দৃষ্টিপথে ধরা দিতে পারে। 'আপ সাইড ডাউন ট্রি'  বাওবাব (আফ্রিকান নাম) স্থানীয়রা বলেন 'খুরসান ইমলি'। খিলজি আমলে মামুদ খিলজি পঞ্চদশ শতাব্দীতে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আনিয়ে এখানে পুঁতেছিলেন যা এখন মান্ডুর অন্যতম প্যাহেচান।
জাহাজমহল এবং রূপমতী প্যাভেলিয়ানে ঢোকার জন্য জনপ্রতি ২৫ টাকা টিকিট লাগে, এবং ভিডিও ক্যামেরা চার্জ ২৫ টাকা। স্টীল ক্যামেরা ও মোবাইলে কোনো চার্জ দিতে হয় না।
মান্ডুতে ঢোকার সময় গাড়ি প্রতি ৫০ টাকা পার্কিং চার্জ নেওয়া হয়।


Comments

Popular posts from this blog

Keonjhar – A hidden Gem of Orissa

ঘাটশিলার ডায়েরী ( The story of Ghatshila )