বাঁকুড়ায় একটি দিন











শীত পড়ে গেলো। হাতের সামনে এক দু দিনের ছুটি দেখলে নিশ্চয়ই চোখটা চকচক করে উঠছে। গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়বার জন্য মন সদা উৎসুক কিন্তু কোথায় যাবেন। চলুন কলকাতা থেকে ২৫০ - ৩০০ কিমি এর মধ্যে কিছু ডে-ট্রিপের খোজ শুরু করি।
শীতে বেড়াতে যাওয়ার একটি আদর্শ জায়গা কিন্তু  দক্ষিণ বাঁকুড়া। আর বাঁকুড়ার কথা মনে করলেই প্রথমেই চোখে ভেসে ওঠে বাঁকুড়ার রানী মুকুটমণিপুরের কথা।পশ্চিম বঙ্গের পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে মহৎ উদ্দেশ্য রূপায়নের তাগিদে ১৯৫৬ সালে খাতড়া মহকুমা হতে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে মুকুটমনিপুর জল সংরক্ষণাগারের পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম  মুকুটমনিপুর জলাধার বাঁধটি  ৮০০০ বর্গকিলোমিটার জায়গার সেচসমস্যার সমাধান করে। পাহাড়শৃংখল, অপার বিস্তৃত সমুদ্রসম নদীপথের অবরুদ্ধ  মাটির বাঁধ, বৃক্ষরাজির অসীম বিস্তৃতি প্রকৃতিপ্রেমিক যেকোনো ব্যক্তিরই হৃদয় আকৃষ্ট করে বারবার।
কিভাবে যাবেন ঃ-
কলকাতা - বরজোরা - দুর্লভপুর - গাংদুয়া ড্যাম - বাঁকুড়া - ইন্দপুর - হাতিরামপুর - মুকুটমনিপুর। পথ দুরত্ব প্রায় ২৮০ কি.মি। টোল ট্যাক্স পড়ে ২২০ টাকা।
গাংদুয়া ড্যাম

পথে গাংদুয়া ড্যামটি কিন্তু বাঁকুড়ার একটি ভবিষ্যৎ পর্যটন কেন্দ্র হতে চলেছে। পাহাড়, জল, জঙ্গল। তিনের মিশেলে মনের আরাম। শহরের ঠাসা ভিড় নেই। চুপিসারে প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে আকাশের রং বাছাবাছি করার এক অনবদ্য সুযোগ ।শালী নদীর ওপর নির্মিত জলাধারটি আকারে ছোট হলেও সৌন্দর্যের নিরিখে কোনো অংশেই কম নয়। জলাধারের গা ঘেষে লাল মাটির পথ চলে গেছে দূরবর্তী গ্রামে। দূরে শুশুনিয়া পাহাড়ের অস্পষ্ট অবয়ব। শালী নদীর কালো জলে নীল আকাশের ছায়া,  পাশেই গাঢ় সবুজ প্রকৃতি, সঙ্গে মৃদুমন্দ হাওয়া বেশ একটা রোমান্টিক পরিবেশের অবতারনা করে।


কিন্তু আমাদের মন যে মুসাফির।  এক যায়গায় তাকে বেঁধে রাখার সাধ্য যে কারো নেই। তাই আবার গাড়ি ছুটে চলে মুকুটমনিপুরের উদ্দেশ্যে।
'দিনে রাতে চলে শুধু একঘেয়ে মন্তাজ,
ক্রমে ক্রমে স্নায়ু শিথিল,
মুখোসে হারায় চেনা চেনা সেই মুখটা,
স্বপ্ন হারায় ক্লোরোফিলl
তাই, নীলনির্জনে..নীলনির্জনে..'
কি গানটা চেনা চেনা লাগছে?  হ্যা ঠিক ধরেছেন গানটি বাংলার একটি জনপ্রিয় সিনেমা 'নীল নির্জনে' এর গান।ছবির লোকেশন কিন্তু এই বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুর।
মুকুটমনিপুর মানেই পরিবারের সবার সাথে নৌকাভ্রমণ, বনপুকুরিয়া ডিয়ার পার্ক, পরেশনাথ শিব মন্দির, মুসাফিরানা ওয়াচ টাওয়ার, মনোরম সূর্যাস্ত ছোটনাগপুর মালভূমির শাল, পলাশের ঘন নিবিড় জঙ্গলের মাঝে গ্রামের লালমাটির রাস্তা,আর সন্ধেবেলা ধামসা মাদলের সঙ্গে আদিবাসীদের নৃত্য।রাস্তার উপরে রঙিন নকশা , সুন্দর পসরা সাজিয়ে বসা সারিবদ্ধ দোকান , রাস্তার পাশে ঝাড়বাতি , নতুন তৈরি বোট বুকিং কাউন্টার , পরিষ্কার অনেকগুলো পে টয়লেট কিন্তু একদম নতুন সাজ দিয়েছে মুকুটমনিপুরকে।
মুকুটমনিপুর ঢুকেই যেটা চোখে পড়বে ড্যামের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া বাঁধানো রাস্তাটা (প্রায় 14 কিমি)lছুটির দিন বাদে এলে লক গেটের কাছে অবস্থিত অফিস থেকে পারমিশন করিয়ে 4 চাকার গাড়ি নিয়ে এই রাস্তায় ড্রাইভ করা যায় । সময় 10am থেকে 4 pm পর্যন্ত । 2 চাকার গাড়ি নিয়ে এলে যখন খুশি যাওয়া যায় ।



পরেশনাথ মন্দির
এই রাস্তার ধারেই রয়েছে মুসাফিরানা -  সুন্দর করে সাজানো একটি টিলা যার উপর থেকে মুকুটমণিপুরের অসাধারণ রূপ দেখা যায় । মুসফিরানার দেয়ালে আঁকা বাঁকুড়ার সব দ্রষ্টব্য জায়গার ছবি । এরপরে একটু গেলে ছোট টিলার উপরে পরেশনাথ মন্দির । বেশ কয়েকটি সিঁড়ি ভেঙ্গে  মন্দিরে উঠতে হয়। পুরোহিত খুবই ভদ্র ও ভালো মানুষ।প্রত্যেক দিন ঠিক দশটায় তিনি মন্দিরে আসেন।দু তিন জন হয়তো পূজো দেয়।কিন্তু খুব নিষ্ঠা করে পূজা করান।কোনো চাহিদা নেই। গুজব শুনলাম ইরিগেশন ড্যাম তৈরীর সময় মাটি খুঁড়ে এই শিব লিঙ্গ পাওয়া গিয়েছিল।পরে এর  মতই আরেকটি বড় লিঙ্গ তৈরী করা হয়। দুটো ই এখন পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত।এখান থেকে আপনার দৃষ্টি আপনার মনকে নাড়া দিয়ে ছুটে যাবে বহুদূরl নীচে ভেসে উঠবে ধানখেত, তালগাছ, গ্রামের দৃশ্যপটl

তার ঠিক পরেই রয়েছে ফেরিঘাট - সেটা পেরিয়ে বনপুকুরিয়া ডিয়ার পার্ক ।ফেরি পেরিয়ে উল্টো দিকে গাড়ি ভাড়া করে বা হেঁটে ঘুরে আসা যায় ডিয়ার পার্ক থেকে । প্রতিদিন সকাল 10 টা ও বিকেল 4 টের সময় হরিনদের খেতে ডাকা হয় ঘন্টা বাজিয়ে । সেই সময় গেলে একসঙ্গে অনেক হরিণ দেখতে পাবেন। ডিয়ার পার্কে আপনারই প্রতীক্ষায় থাকা হরিণ গুলোকে নিজের হাতে খাওয়ান। মুকুটমণিপুর ড্যাম ঘোরার আরো একটা ভালো উপায় হলো নৌকা ভাড়া করে নেয়া । নৌকা মুসফিরানা , পরেশনাথ মন্দির , ডিয়ার পার্ক , মোহনা দেখিয়ে আবার ফিরিয়ে আনে । ঘোরাঘুড়ি  শেষে খিদে পেয়ে গেছে তো।  ঢুকে পড়ুন রাস্তার ধারে ঝোপড়ি দোকানগুলোতে। পরিষ্কার শালপাতাতে পেটচুক্তিতে দেশী মুরগীর ডিম মাংস খান, দু টাকার ঝাল চপ খান, কাঁচের গ্লাসে নির্ভেজাল দুধের চা খান সাথে বাঁকুড়ার মিষ্টি টেষ্ট করে দেখুন। মানে মন  যা চায় সবই জিভকে দিয়ে পরখ করিয়ে নিন।আর শীত নামলে ভোর বেলায় সহজেই সেখানে মিলতে পারে পছন্দের খেজুর রস বা মাতাল করা তাড়ি ও গুড়l একটু খোঁজ নিলে পেয়ে যেতে পারেন দেশী মহুয়ার রসওl বাড়ি বা শখের জন্য কিনে নিতে পারেন নানান সৌখিন বাঁশের কাজ।



মুকুটমনিপুর ঘোরা শেষ।  কিন্তু আমাদের ঘোরা তো এখনো অনেক  বাকি। তাই ফেরার পথে একটু অন্য রাস্তা ধরুন।  মুকুটমণিপুর থেকে 4 km দূরে আছে আম্বিকানগর - পূর্বনাম ছিল আমাইনগর ।অম্বিকানগর রাজপরিবারের পূর্বপুরুষরা ছিলেন রাজস্থানের ঢোলপুরের বাসিন্দা৷ প্রায় চারশো বছর আগে তাঁরা রাজস্থান থেকে চলে আসেন বাঁকুড়ার সুপুর গ্রামে৷ সম্পত্তি নিয়ে গোল বাধে পরিবারে৷
একপক্ষ দশ আনা ও অপর পক্ষ ছ’আনা সম্পত্তির অধিকারী হন৷ যাঁরা দশ আনা সম্পত্তি পেয়েছিলেন, তাঁরা জমিদারি পত্তন করেন খাতড়া গ্রামে৷ ছ’আনার জমিদারেরা চলে যান কংসাবতী ও কুমারী নদীর মাঝে এক প্রত্যন্ত গ্রামে৷ সেখানেই নতুন করে শুরু করেন রাজ্যপাট৷ গ্রামে স্থাপন করা হয় দেবমন্দির৷ পরিবারের জাগ্রত দুই দেব-দেবী অম্বিকা ও কালাচাঁদ৷ কথিত আছে, দেবী অম্বিকার নামেই রাজধানীর নাম হয় অম্বিকানগর৷ রাজপরিবারের সঙ্গে বিপ্লবীরা জড়িয়ে পড়েন রাজা রাইচরণ ধবলদেবের আমলে৷  রাইচরণ ধবলদেব ছিলেন স্বভাব-দুঃসাহসী৷ রাজপ্রাসাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে তিনি নাম লিখিয়েছিলেন বিপ্লবীদের দলে৷ তাঁর নেতৃত্বেই জঙ্গলমহলে গড়ে উঠেছিল বিপ্লবী বাহিনী৷ নিয়মিত যাতায়াত ছিল ক্ষুদিরাম বসু, বারীন ঘোষ, প্রফুল্ল চাকী, ভূপেশ দত্ত, নরেন গোঁসাইদের৷ আর এই রাজবাড়িই ছিল তাঁদের মন্ত্রণাকক্ষ৷ গভীর রাতে এখান থেকেই ঘোড়ায় চড়ে তাঁরা যেতেন ছেন্দাপাথরের গোপন ডেরায়৷ সেখানে গুহার ভিতরে বোমা, বন্দুক তৈরির গুপ্ত কারখানা ছিল৷
কথিত আছে  ‘একবার পুরীর পান্ডার ছদ্মবেশে রাজবাড়ির সিংহদ্বারের কুঠুরিতে আশ্রয় নেয় এক ব্রিটিশ চর৷ তার কাছ থেকে খবর পেয়েই কলকাতার পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট বিশাল বাহিনী নিয়ে রাজবাড়িতে হানা দেন৷ আলিপুর বোমা মামলায় ধরা পড়েন রাইচরণ আর তাঁর তিন সঙ্গী৷ ধরা পড়েন নরেন গোঁসাইও৷ পরে নরেন গোঁসাই খুন হওয়ায় প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস পেয়ে যান রাইচরণ৷ তিনি যেদিন জেল থেকে ছাড়া পান সেদিন ছিল ষষ্ঠী৷ ছাড়া পেয়েই সঙ্গীসাথি নিয়ে বাড়ি ফিরে পুজোয় মাতেন রাইচরণ৷ সে সময় নাকি পুজোর ক’টা দিন এখানে লুকিয়ে থাকতেন বহু বিপ্লবী৷ গোপনে পুজোও দেখতেন৷’ তবে এখন আর সে রামও নেই, নেই সে অযোধ্যাও৷ রাজপরিবারের গরিমা তলানিতে তবুও পুরানো স্মৃতি বুকে চেপে নিয়ে এগিয়ে চলেছে এই অম্বিকানগর।
এবার গাড়ি নিয়ে  রানিবাঁধ হয়ে চলুন ঝিলিমিলি জঙ্গলের দিকে । রাস্তায় পড়বে তিন তিনটে ওয়াচ টাওয়ার । এখান থেকে পাহাড় ও ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দূরের মুকুটমণিপুর ড্যাম দেখতে অসাধারণ লাগবেই লাগবে আপনার । এরপর আরো কিছুটা গেলে রাস্তার বামদিকে পড়বে সুতান যাওয়ার রাস্তা । ঘন জঙ্গল -   গা ছমছম করা পরিবেশ আর পাহাড়ি চড়াই উৎরাই পথ পেরিয়ে পৌঁছবেন সুতান ফরেস্ট বাংলো । রাস্তায় আপনার গাড়ির সামনে উড়ে আসতে পারে ময়ূর । সুতানে জঙ্গলের ভিতরে একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে - যেখান থেকে চারিদিকের জঙ্গলের রূপ দেখা যায় । সুতান থেকে আবার মেন রাস্তায় ফিরে এগিয়ে চলুন । আবার বাম দিকে একটা রাস্তা আসবে - তালবেরিয়া ড্যাম যাওয়ার । খুব সুন্দর একটি পিকনিক স্পট । সরকারি ভাবে নতুন করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে এলাকাটি । এরপর রয়েছে ঝিলিমিলি । এখানে একটি ভালো রিসোর্ট আছে - যেখানে গাছবাড়িতে থাকার সুযোগ রয়েছে ।
বাঁকুড়া থেকে দূরত্বগুলো একটু চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন।


1. বাঁকুড়া থেকে খাতড়া হয়ে মুকুটমণিপুর - 50 km
2. খাতরা থেকে মুকুটমণিপুর - 7 km
3. মুকুটমনিপুর থেকে রানিবাঁধ - 17 km
6. খাতরা থেকে সুতান - 28 km
7.সুতান থেকে তালবেরিয়া ড্যাম - 24 km
8 . তালবেরিয়া থেকে ঝিলিমিলি - 7 km
9. ঝিলিমিলি থেকে ঝাড়গ্রাম - 65 km
ঝিলিমিলি থেকে শিলদা, দহিঝুড়ি হয়ে ঝাড়্গ্রামের রাস্তা ধরুন। হাতে সময় থাকলে কনকদুর্গা মন্দির এবং চিল্কিগড় রাজবাড়িটি দর্শন করে নিতে পারেন। বেশ বেশ সারাটাদিন তো ভালোই কাটলো। তা শেষপাতে একটু কব্জি ডুবিয়ে খাওয়াদাওয়া না হলে জমে। তাই কোলাঘাটে ঢুকে গাড়িটা টুক করে একটা ধাবায় ঢুকিয়ে চোব্যচোষ্য অর্ডার দিয়ে ফেলুন, আর আমিও আপনাদের থেকে বিদায় নিয়ে গুনগুনতা এগিয়ে যাই -
'চলতে চলতে মেরে ইয়ে ট্রিপ ইয়াদ রাখনা
কভি আলবিদা না কহেনা...'
আজকের মত এখানেই শেষ। আবার হয়তো দেখা হবে কোনও নতুন পথের বাঁকে।






Comments

Popular posts from this blog

Keonjhar – A hidden Gem of Orissa

ঘাটশিলার ডায়েরী ( The story of Ghatshila )

মান্ডুর প্রেম কথা