Some Hidden Jem of Orisha (ওড়িশার কিছু নাম না জানা মুক্তমানিক্য)
পকেটমার হইতে সাবধান
কথিত আছে পাণ্ডবরা বনবাসকালে কপিলাসে আসেন, পুজো দেন নাগবেষ্টিত শিলারুপী মহেশ্বরের।
পয়লা নজরেই মন কেড়ে নেওয়া কপিলাস আয়তনে খুবই সামান্য। পাহাড়ের পায়ের কাছে বাগান ঘেরা বিরাট হাতার মাঝে দাড়িয়ে ও টি ডি সির পান্থশালা একমাত্র পর্যটক আবাস। পান্থশালার গেটের বাইরে আছে গোটা দুই ঝুপড়ি এবং একটি মাত্র নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান । চারদিকে প্রকৃতি সবুজের বিপুল সম্ভার নিয়ে হাজির। গাছগাছালির ফাক দিয়ে এক মাথা নীল আকাশ নিয়ে দাড়িয়ে কপিলাস পাহাড়।
মন্দিরমুখী পথের বাঁকে চিড়িয়াখানা ( মঙ্গলবার বন্ধ), ঘড়িয়াল প্রজনন কেন্দ্র, বোটিং ব্যবস্থা সহ লেক, সায়েন্স পার্ক কপিলাসের অন্যতম আকর্ষন।
সায়েন্স পার্কটি সুন্দর বাগানে ঘেরা এক এলাহি ব্যাপার! বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রকৃতিকে কীভাবে কাজে লাগিয়ে মানব সভ্যতার উন্নতি সম্ভব তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে অগুনতি মডেল আর ফলকে।
সায়েন্স পার্ক থেকে পায়ে হেঁটে পৌছে যাওয়া যায় দেওগার পথে ছোট্ট গ্রামে। বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। গ্রামের ঠিক মাঝখানে আটচালা পুজোমণ্ডপ। গ্রামের প্রাইমারি স্কুল, পঞ্চায়েত অফিস, দোকানপাট ছাড়াও চোখে পড়ে বেশ কিছু পাকা দেওয়ালের ঘরবাড়ি। বিজলী বাতি সব বাড়িতে অবশ্যই নেই তবু মোটের ওপর গ্রামখানা ছিমছাম বলা চলে।
কপিলাস চন্দ্রশেখর শিব মন্দির
কপিলাসের প্রধান আকর্ষন চন্দ্রশেখর শিবের মন্দির।পান্থশালা থেকে ঘাট রোড ধরে ৫ কিলোমিটার দূরের এই দেবস্থানে যাওয়া যায় ১৫০ টাকায় জিপ ভাড়া নিয়ে। এছাড়াও দু’কিলোমিটার দুরত্বের পাথুরে সিড়ির একটা রাস্তাও আছে হেঁটে ওঠার জন্য। ১৩৬৫টি ধাপওয়ালা এই হাটাপথে প্রকৃতিকে পাওয়া যায় আর একটু আপন করে। বট, অশ্বত্থ, বেল, আমলকী, হরতুকী আর বহেড়ার ছায়া ঘেরা পথে মন মাতানো নাম না জানা বুনো ফুলের গন্ধ আর রঙিন প্রজাপতির মেলা ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়।
দেবসভা
প্রাচীন মিন্দরের রক্ষণাবেক্ষণ দেখার মত। ওড়িশার বিখ্যাত মিন্দর স্থাপত্যের এ আর এক নমুনা। তবে মন্দিরের গায়ের মূল্যবান কারুকাজ ঢেকে গেছে চুনকামের মোটা প্রলেপে। মন্দিরের পাথুরে উঠোনে দারুণ সুন্দর কাঠখোদাই করা একটা ছত্রী। গর্ভগৃহে নাগবেষ্টিত চন্দ্রশেখরের পুজো দেখাশোনার দায়িেত্ব আছেন পাণ্ডারা। মূল মিন্দরের পূবদিকে পাচশো ফুট ওপরে বিষ্ণু ও কাশীর বিশ্বনাথের দুটো মিন্দর। দেখে মনে হয় প্রায় সমসাময়িক কালেই তৈরী। এই মন্দির দুটো ছাড়িয়ে পথ গিয়েছে আরও কিছুটা।প্রচুর হনুমানের উৎপাত। পাহাড়ের চুড়োর কাছাকাছি কয়েকটা গুহা। এই প্রাকৃতিক গুহাগুলো ঘিরেও অনেক পৌরাণিক কাহিনী। ইতিহাস জানাচ্ছে, এরই এক গুহায় তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেন মহাসাধক মহিমা গোসাই যিনি তার ‘‘মহিমাবাদ’’ প্রচার করে পরে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ভগবৎ প্রচারক শ্রীধর স্বামীও সাধনা করেছিলেন এইখানে। তাই জায়গাটি দেবসভা নামে বেশি বিখ্যাত।
কপিলাসের অপর আকর্ষন ডিয়ার পার্ক । পান্থশালার খুব কাছেই এই পার্ক এক ছোটখাটো চিড়িয়াখানা। শহুরে নামজাদা সব পশুশালার চেয়ে অনেকটাই আলাদা এই অখ্যাত মৃগদাব তার সুন্দর সবুজ পরিবেশের জন্য। চিতল হরিণ আর সম্বর চরে বেড়ায় বিরাট ঘেরা মাঠে যার মধ্যে ফাকে ফাকে অনেক বড় গাছ আছে দরকারি ছায়ার যোগান দিতে। ভালুকের ডেরা পরিখার ধারে কৃত্রিম গুহা। আছে বনবেড়াল, শেয়াল, সজারু, নেউল আর খরগোশ। টিয়া, ময়না, চন্দনা, মৌটুসির মত খাচায় রাখা পাখি ছাড়াও উচু গাছের ডালে বসে ডাকছে দোয়েল, ঘুঘু, বসন্তবৌরি, বেনেবউ, মাছরাঙা আর দাড়কাক। চিড়িয়াখানার মধ্যে আছে এক বিশাল লেক। লেকের জলে শীতে উড়ে আসে অনেক পরিযায়ী পাখি। এখানকার স্থায়ী বাসিন্দারা হল পানকৌড়ি, ডাহুক আর জলপিপি। এই লেকের এক ধারে তৈরী হয়েছে বিপন্ন প্রজাতির ঘড়িয়াল সংরক্ষণ ও প্রজনন কেন্দ্র। উৎসাহী পর্যটকদের জন্য কর্তৃপক্ষ নৌকোভ্রমণের ব্যবস্থাও রেখেছেন।
সপ্তশয্যার পথে |
কপিলাস ছেড়ে ঢেনকানল হয়ে ১১ কিলোমিটার দক্ষিণে সপ্তশয্যা একটি ভার্জিন পিকনিক স্পট। ঘন্টাখানেকের জিপযাত্রা শেষে অল্প পায়ে চলা রাস্তায় পৌছে যাওয়া যায় সপ্তশয্যা। অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশ এখানে। অরন্যময় দুর্গম পাহাড়ে সপ্তঋষির তপস্যাস্থল এই সপ্তশয্যা। মুর্তিও রয়েছে ধ্যানমগ্ন সাত ঋষির (মারীচ, বশিষ্ঠ, অঙ্গিরা, অত্রি, পুলস্ত্য, পুলহ ও ক্রতু )। এখানের আনাচে কানাচেও জড়িয়ে আছে মহাভারতের গল্প। অষ্টাদশ শতকের রানী রতুপ্রভা দেবীর উৎসাহে তৈরী রঘুনাথের মন্দির আছে এখানে ।কথিত আছে শ্রীরাম বনবাসকালে এখানে কিছুদিন বসবাস করেন। খানিকটা দূরে বয়ে চলেছে এক ছোট ঝোরা।
ঢেনকানল থেকে ৭ কিমি উত্তর-পুবে কাইমাটি পৌঁছে সেখান থেকে ১৫ কিমি দূরে জোরান্ডা – মহিমা ধর্মীয়দের ১৮২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দেবতাহীন মন্দির। বিরাট চত্বর জুড়ে এঁদের কর্মকাণ্ড। ধুনি মন্দির নীতি মন্দির , গাদি মন্দির, অখন্ড বাতি মন্দির, জ্যোতি মন্দির প্রত্যেকটিই বিশেষতব দাবি করে। মাঘী পুর্নিমায় কৌপিনধারী সাধুরা আসে দুরদুরান্ত থেকে।
পরবর্তী গন্তব্য ডোকরা গ্রাম। ডোকরা শিল্পের জন্য বিখ্যাত এই গ্রামটি ঢেঙ্কানলের মূল শহর ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা দূরে অবস্থিত। পাহাড়ের পাদদেশে কয়েকঘর ডোকরা-শিল্পীর বাস, তাঁরা পুরুষানুক্রমে এই একই কাজ করে যাচ্ছেন। প্রথমে পোড়ামাটির ছাঁচ তৈরি করে তার উপর কালো মোমের ডিজাইন বানানো হয়, তারপর সেই ডিজাইনের উপর অদ্ভুত কায়দায় গলিত পিতল ঢেলে সেটাকে জমাট করা হয়। জমে যাওয়ার পর পিতলে সেই ছাঁচটা বসে গিয়ে তৈরি হয় অপূর্ব সব মূর্তি।
এই ট্রিপের সর্বশেষ আকর্ষন অনুসুপা লেক। ঢেঙ্কানল থেকে ৩০ কিমি দূরে প্রকৃতিদত্ত লেকই অনুসুপার প্রধান আকর্ষন। শীতে চেনা অচেনা পরিযায়ী পাখিদের মেলা বসে এই লেকের জলে।
কিভাবে যাবেন :-
ট্রেনে গেলে কটক স্টেশনে নামুন। বাদামবাড়ি বাসস্টপ থেকে সম্বলপুর, তালচের, অঙ্গুল বা ঢেনকানলের বাস ধরে ৫২ কিমি দূরে ঢেনকানল নামুন। ঢেনকানলের থেকে দেঁওগাঁর ট্রেকার ধরে ২০ কিমি দুরে সোজা কপিলাস।
গাড়িতে গেলে কটক থেকে ঢেনকানলের দিকে এগোলে ঢেনকানল থেকে ৭ কিমি আগে সিয়াড়ি থেকে ডানদিকে রাস্তা চলে গেছে কপিলাসের দিকে।
বিশেষ বক্তব্য ঃ-
এই সার্কিটটা ঘোরার বেস্ট সময় শীতকাল। নভেম্বর থেকে মার্চ।
কপিলাসে থাকার যায়গা একমাত্র OTDC. তাই কপিলাসে না থাকতে পারলে ঢেঙ্কানলে থেকেও এগুলি ঘুরে নেওয়া সম্ভব। প্রথম দিন ঢেনকানল থেকে অটো বা গাড়ি ভাড়া করে কপিলাস আর জোরান্ডা। দ্বিতীয় দিন সকালেই গাড়ি বা জিপ ভাড়া করে ঘুরে আসুন আনসুপা ও সপ্তশয্যা। ফিরে দুপুরের খাওয়া সেরে ঢেনকানল শহরের দ্রষ্টব্যগুলো অটো ভাড়া করে দেখে নিন।
নানা প্রাচীন মন্দিরের শহর ঢেনকানল – এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বলরাম, রঘুনাথ, কুঞ্জকান্ত, শম্ভুগোপাল ইত্যাদি।
ঢেনকানল থেকে সপ্তশয্যা গেলে গাড়ি রেখে শেষ কিছুটা পথ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে শ’ খানেক সিঁড়ি ভেঙে রঘুনাথ মন্দিরে পৌঁছতে হয়।
দেওদার গ্রামের ছানাপোড়া বেশ বিখ্যাত।
এই ব্লগের দু একটি ছবি নেট থেকে ধার করা। কেউ উপযুক্ত প্রমানসহ দাবী করেন ছবিটি তার তোলা , তৎক্ষনাৎ ছবিটি ব্লগ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে।
Comments
Post a Comment